একটু আগে মেরাব আমাকে যা বলেছিল তাতে আমি আন্দাজ করেছিলাম যে, খুব বেশি হলে হয়তো আরো তিন থেকে চার শ হিকসস সৈন্য আমাদের পেছনে এসে হাজির হয়েছে, দুই দিক থেকে আমাদের আক্রমণ করার মতলব ওদের। ওই তিন-চার শ সৈন্যই অবশ্য আমাদের শবাধারে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। কিন্তু এখন আমি দেখলাম আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার পদাতিক সৈন্যসহ বিশাল এক সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে, সাথে কমপক্ষে পাঁচ শ রথ আর একই পরিমাণ অশ্বারোহী। নীলনদের এই তীরেই অবস্থান নিয়েছে তারা। বিদেশি যুদ্ধজাহাজের একটা বাহিনী থেকে নেমে আসছে সবাই। সোনালি শহর লুক্সরের নিচে নদীর তীরে নোঙর ফেলেছে। জাহাজগুলো।
শত্রুদের অশ্বারোহী সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ নেমে পড়েছে তীরে। বারো কি তেরোজন অশ্বারোহী নিয়ে গঠিত আমাদের ছোট্ট দলটাকে দেখার সাথে সাথেই ঘোড়া ছুটিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে এলো তারা, উদ্দেশ্য আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। বুঝতে পারলাম, ওদের সামনে একেবারেই অসহায় আমরা। ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে আমাদের বেশির ভাগ ঘোড়া। এখন যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করি, সন্দেহ নেই যে শত্রুদের শক্তিশালী এবং তাজা ঘোড়াগুলো এক শ কদম যাওয়ার আগেই আমাদের ধরে ফেলবে। আবার যদি অবস্থান ধরে রেখে লড়াই করতে চাই তাহলে এক ফোঁটা ঘামও না ঝরিয়ে আমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে ওরা।
তবে তার পরেই হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারলাম আমি, নতুন দৃষ্টিতে তাকালাম এই আগন্তুকদের দিকে। খুব সামান্য একটু স্বস্তির ছোঁয়া লাগল আমার মনে, তবে আমার সাহসকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট। ওদের কারো মাথায় হিকসস ধাচের শিরস্ত্রাণ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি যে জাহাজগুলো থেকে ওরা নেমে আসছে সেগুলোর সাথেও হিকসসদের যুদ্ধজাহাজের চেহারার কোনো মিল নেই।
দাঁড়াও ক্যাপ্টেন মেরাব! ধমকে উঠলাম আমি। এই আগন্তুকদের সাথে প্রথমে আমি কথা বলতে যাব। তারপর তরুণ ক্যাপ্টেনকে তর্ক করার কোনো সুযোগ না দিয়ে কোমর থেকে খুলে আনলাম খাপসহ তলোয়ার এবং খাপ থেকে বের না করে উল্টো করে ধরলাম, শান্তির সর্বজনীন চিহ্নের অনুকরণে। তারপর বিদেশি অশ্বারোহীদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘোড়া নিয়ে ধীরগতিতে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার মাঝে যে হতাশার অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার কথা এখনো মনে আছে আমার। বুঝতে পারছিলাম যে, এবার বোধ হয় ভাগ্যনিয়ন্তা দেবী টাইকির ওপরে একটু বেশিই ভরসা করা হয়ে গেছে। তার পরেই অবাক হয়ে দেখলাম অশ্বারোহী দলটির নেতা চড়া গলায় নির্দেশ দিল কিছু একটা, সাথে সাথে তার দলের সবাই নিজেদের তলোয়ার খাপবদ্ধ করে ফেলল আবার। তারপর নেতার পেছনে ঘোড়া নিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল তারা।
তাদের উদাহরণ অনুসরণ করে আমিও আমার ঘোড়াটাকে দাঁড় করালাম, ফলে দলের নেতা এবং আমার মাঝে দূরত্ব থাকল স্রেফ বিশ কি ত্রিশ কদম। এই অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে যতটা সময় লাগে ঠিক ততক্ষণই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর নিজের চেহারা দেখানোর জন্য আমার দোমড়ানো শিরস্ত্রাণের ভাইজর বা সামনের মুখাবরণ ওপরে তুলে দিলাম আমি।
.
হেসে উঠল বিদেশি অশ্বারোহী দলের নেতা। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে শব্দটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত লাগল; কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত পরিচিতও মনে হলো আমার কাছে। এই হাসির শব্দ আমি চিনি। তার পরেও প্রায় আধা মিনিট ধরে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে, এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় উদ্ধার কতে পারলাম। এখন অনেক বয়স হয়েছে তার; কিন্তু একই সাথে বিশাল পেশিবহুল এবং আত্মবিশ্বাসী চেহারা। তারুণ্যে ভরপুর সদা ব্যগ্র চেহারার সেই ছেলেটার আর কোনো চিহ্ন নেই, যে কিনা এই কঠিন আর রুক্ষ পৃথিবীতে নিজের একটা জায়গা খুঁজে বেড়াত সব সময়। নিশ্চয়ই সেই জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে সে। এখন তার ব্যক্তিত্বে পূর্ণ কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট, পেছনে রয়েছে এক বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
জারাস? সন্দিহান গলায় নামটা উচ্চারণ করলাম আমি। আমি যাকে দেখছি সে নিশ্চয়ই তুমি নও, তাই না?
নামটা একটু বদলে গেছে; কিন্তু আমার আর সব কিছুই সেই আগের মতোই আছে, টাইটা। তবে এটা বলতে পারো যে আগের চাইতে বয়স একটু বেড়েছে, সাথে বোধ হয় একটু জ্ঞানীও হয়েছি।
এতগুলো বছর পরেও আমাকে মনে রেখেছ তুমি। কত দিন হলো? তাকে প্রশ্ন করলাম আমি।
বেশি না, মাত্র ত্রিশ বছরের মতো। আর হ্যাঁ, এখনো তোমাকে মনে রেখেছি আমি। আর কোনো দিন ভুলব বলেও মনে হয় না, এমনকি বর্তমান বয়সের চাইতে আরো দশ গুণ বেশি বাঁচার সুযোগ পেলেও তোমাকে মনে থাকবে আমার।
এবার আমার হেসে ওঠার পালা। নামটা বদলে গেছে তোমার, তাই তো বললে? এখন তাহলে কী নামে পরিচিত তুমি জারাস?
এখন আমার নাম হুরোতাস। আমার আগের নামটা নিয়ে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঝামেলা তৈরি হয়েছিল, জবাব দিল সে। ব্যাপারটাকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না দেখে মুচকি হাসলাম আমি।
তার মানে ল্যাসিডিমনের রাজা আর তোমার নাম এখন একই? প্রশ্ন করলাম আমি। নামটা আগেই শুনেছি আমি, এবং প্রত্যেকবারই গভীর সম্মান আর বিস্ময়ের সাথে উচ্চারিত হয়েছে সেটা।