এই ঢালের প্রাচীরের মাঝে আমাকে এতবার যুদ্ধ করতে হয়েছে যে, শুধু এই পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্যই একটা বিশেষ অস্ত্রের নকশা করেছি আমি। এমন অবস্থায় পদাতিক সৈনিকের লম্বা তলোয়ার কোনো কাজে আসে না, সুতরাং সেটা খাপেই রেখে দিতে হয়। তার বদলে ব্যবহার করা হয় একটা সরু ছোরা, যার ফলার দৈর্ঘ্য হবে খুব বেশি হলে হাতের কবজি থেকে আঙুলের ডগার সমান। যখন বর্মপরা দেহের চাপে নিজের দুটো হাতই আটকা পড়ে যায়, শত্রুর মুখ থাকে নিজের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে, তখনো এই ছোট্ট অস্ত্রটা ব্যবহার করতে অসুবিধা হয় না। শত্রুর বর্মের সামনের দিকে কোনো একটা ফুটোয় ঢুকিয়ে দিতে হয় ছুরির ফলা, তারপর চাপ দিয়ে পাঠিয়ে দিতে হয় জায়গামতো।
সেই দিন লুক্সরের প্রবেশপথের রাস্তায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্তত দশজন বিশালদেহী দাড়িওয়ালা হিকসস বর্বরকে খুন করলাম আমি, একবারও কয়েক ইঞ্চির বেশি নাড়ানো লাগল না আমার ডান হাত। আমার হাতে ধরা ছুরির ফলা শত্রুর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে বিদ্ধ করার সাথে সাথে ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠতে লাগল তাদের চেহারাগুলো। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা শেষ নিঃশ্বাসটুকু গরম ভাপ ছড়িয়ে দিল আমার মুখের ওপর। পুরো ব্যাপারটা অদ্ভুত এক সন্তুষ্টির অনুভূতি জাগিয়ে তুলল আমার মনে। এমনিতে আমি নিষ্ঠুর বা অত্যাচারী প্রকৃতির মানুষ নই; কিন্তু দেবতা হোরাস সাক্ষী আছেন, আমি এবং আমার লোকেরা এই বর্বর জাতিগোষ্ঠীর হাতে যথেষ্ট অত্যাচার সয়েছি। এখন তাই যেকোনো উপায়ে প্রতিশোধ নিতে পারাই আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।
জানি না এভাবে কতক্ষণ ওই ঢালের প্রাচীরে বন্দি হয়ে ছিলাম আমরা। আমার কাছে মনে হলো যেন বহু ঘণ্টা ধরে এমন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু মাথার ওপর নিষ্করুণ সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন দেখে বোঝা গেল যে এক ঘণ্টারও কম সময় পার হয়েছে। তার পরেই হঠাৎ হিকসসরা নিজেদের ঢাল ছাড়িয়ে নিল, একটু দূরে সরে গেল আমাদের কাছ থেকে। লড়াইয়ের তীব্রতায় দুই দলই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মাঝখানের সরু এক চিলতে মাটির ওপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমরা বুনো জন্তুর মতো হাঁপাচ্ছি। নিজেদের রক্ত আর ঘামে ভিজে আছে সবার শরীর, টলতে টলতে দাঁড়িয়ে আছি কোনোমতে। যদিও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমার জানা আছে এই বিশ্রামের দৈর্ঘ্য খুবই সামান্য, তার পরেই পাগলা কুকুরের মতো আবার একে-অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা। এটাও জানি যে, আজই আমাদের শেষ লড়াই। নিজের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালাম আমি। দেখলাম ওরাও সবাই শেষ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। খুব বেশি হলে বারো শর মতো হবে ওদের সংখ্যা সব মিলিয়ে। ঢালের প্রাচীর তুলে ধরে হয়তো আরো ঘণ্টাখানেকের মতো টিকে থাকতে পারবে ওরা; কিন্তু তার বেশি নয়। তার পরেই সব শেষ হয়ে যাবে। তীব্র দুঃখবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইল আমাকে।
তখনই হঠাৎ কে যেন আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। আমার হাত ধরে টান দিল সে, চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। যদিও কথাগুলোর অর্থ প্রথমে আমার মাথায় ঢুকতে চাইল না। প্রভু টাইটা, আমাদের পেছনে আরো একটা বড় সেনাদল এসে হাজির হয়েছে। আমাদের সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেছে ওরা। এখন আপনি যদি আমাদের বাঁচানোর মতো কোনো রাস্তা খুঁজে বের করতে না পারেন তাহলে আমরা শেষ!
কে এমন ভয়ানক খবর নিয়ে এলো দেখার জন্য চরকির মতো ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। এই কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের অবস্থা সত্যিই শোচনীয়। কিন্তু আমার সামনে যে মানুষটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তার কথা অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়। ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর অন্যতম এক তরুণ সৈনিক, সে এক শ একতম ভারী রথ বাহিনীর দলনেতা। আমাকে নিয়ে চলো সেখানে মেরাব! তাকে নির্দেশ দিলাম আমি।
এইদিকে আসুন প্রভু! আপনার জন্য একটা তাজা ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছি আমি। মেরাব নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল যে আমি কতটা ক্লান্ত, কারণ কথাটা বলেই আমার হাত চেপে ধরল সে, তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃত এবং মৃতপ্রায় মানুষ আর নানা রকমের অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিসের স্তূপ ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। সেনাদলের পেছন দিকে থাকা নিজেদের অশ্বারোহী সৈনিকদের কাছে চলে এলাম আমরা। এখানে দুটো ঘোড়াকে আমাদের জন্যই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। ততক্ষণে অবশ্য কিছুটা শক্তি ফিরে পেয়েছি আমি, ফলে মেরাবের হাতটা সরিয়ে দিলাম। নিজের সৈন্যদের সামনে, এমনকি সামান্যতম দুর্বলতার চিহ্নটুকুও দেখাতে চাই না আমি।
একটা ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমি, তারপর অশ্বারোহীদের ছোট্ট দলটা নিয়ে সেই উঁচু জায়গাটার ওপরে উঠে এলাম, যেটা আমাদের অবস্থান থেকে নীলনদের নিচু পাড়কে পৃথক করেছে। জায়গাটার ওপর উঠে আসার সাথে সাথে আমি এমন আচমকাভাবে আমার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম যে, আঁকি দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে ফেলল প্রাণীটা, ছটফটে পায়ে চক্কর খেল একটা। চোখের সামনে যে দৃশ্যটা দেখলাম তাতে নিজের হতাশা কীভাবে প্রকাশ করব তার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না আমি।