দূরে পথের অন্য পাশে ভোরের কুয়াশার মাঝে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করল শত্রু সৈন্যদের অগ্রযাত্রা। দূরত্ব আর স্বল্প আলোর কারণে প্রথমে তাদের দলটাকে ছোটখাটো দুর্বল বলে মনে হলো; কিন্তু আমাদের দিকে তারা এগিয়ে আসার সাথে সাথে দ্রুত বেড়ে উঠল আকারে। চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে আকাশে উড়াল দিল শকুনরা, শেয়াল আর অন্যান্য শবভোজী প্রাণীর দল এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল তাদের এগিয়ে আসার সাথে সাথে। পথের সম্পূর্ণ প্রস্থ পূর্ণ হয়ে গেছে হিকসস বাহিনীর কারণে, যা দেখে আরো একবার সাহস হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম আমি। মনে হচ্ছে যেন আমাদের চাইতে কমপক্ষে তিন বা চার গুণ হবে ওদের পরিমাণ।
তবে আরো কাছে এগিয়ে আসার পর আমি দেখলাম আমাদের ওপর ওরা যা অত্যাচার চালিয়েছে তার সাধ্যমতো জবাবও আমরা দিয়েছি। ওদের বেশির ভাগই আহত, আমাদের মতোই ক্ষতস্থান বেঁধে রেখেছে রক্তে ভেজা ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে। কেউ কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগোচ্ছে, বাকিদের অবস্থাও ভালো নয়। সেনাবাহিনীর সার্জেন্টদের অনেকের হাতেই রয়েছে পশুর চামড়ার তৈরি চাবুক, তাদের তাড়া খেয়ে হোঁচট খেতে খেতে আগে বাড়ছে তারা। নিজেদের সৈন্যদের সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে এমন কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে হিকসসরা, দেখে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। রথ চালিয়ে আমাদের বাহিনীর সামনে চলে এলাম এবার। চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছি আমার লোকদের, সেইসাথে দেখাচ্ছি হিকসস ক্যাপ্টেনদের হাতে থাকা চাবুকের দিকে।
দায়িত্বের গুরুত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য কখনো চাবুকের ভয় দেখাতে হয়নি তোমাদের, হিকসস ঢাকের শব্দ আর তাদের বর্মপরা পায়ের ঝনঝনানি ছাপিয়ে পরিষ্কারভাবে সবার কানে পৌঁছে গেল আমার কণ্ঠস্বর। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল আমার লোকেরা, অপমান আর ঠাট্টা-তামাশা জুড়ে দিল ক্রম অগ্রসরমাণ শত্রুকে লক্ষ্য করে। পুরো সময়টা জুড়ে দুই সেনাবাহিনীর মাঝে দ্রুত কমে আসতে থাকা দূরত্বটা মেপে নিচ্ছিলাম আমি। এই যুদ্ধ শুরুর সময়ে তিন শ বিশটা রথ ছিল আমার কাছে, এখন সেখানে আছে আর মাত্র বায়ান্নটা। ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ায় সত্যিই খুব অসুবিধা হয়ে গেছে। তবে আমাদের একমাত্র সুবিধা হচ্ছে এই খাড়া এবং বন্ধুর পথের মাথায়। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অবস্থানে আছি আমরা। নিজের দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য যুদ্ধ থেকে পাওয়া সমস্ত বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই এই অবস্থানকে বেছে নিয়েছি আমি।
নিজেদের তীরন্দাজদের তীরের পাল্লার মাঝে আমাদের নিয়ে আসার জন্য রথের ওপর অনেক অংশে নির্ভর করে হিকসসরা। আমাদের দুই প্রান্ত বাঁকানো ধনুকের উদাহরণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও ওরা কখনো এমন কিছু বানানোর চেষ্টা করেনি, তার বদলে গোঁয়ারের মতো নিজেদের সোজা ধনুক আঁকড়ে ধরে থেকেছে। আমাদের অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্রগুলোর মতো এত বেশি দূরত্বে এবং দ্রুততার সাথে তীর ছুঁড়তে পারে না ওদের ধনুক। পাথুরে পথটার প্রবেশমুখেই রথ রেখে আসতে বাধ্য করেছি ওদের, ফলে এটাও নিশ্চিত হয়ে গেছে যে ওদের তীরন্দাজরা এত তাড়াতাড়ি তীর ছোঁড়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে আসতে পারছে না।
এবার সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত উপস্থিত, যে রথগুলো বাকি ছিল সেগুলো ব্যবহার করার সময় হয়েছে। নিজে রথ বাহিনীর নেতৃত্ব দিলাম আমি, রথগুলোকে সারিবদ্ধ অবস্থায় সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলাম হিকসসদের দিকে। ষাট অথবা সত্তর কদম দূরে থাকতে তীর ছুড়ল আমাদের তীরন্দাজরা, লক্ষ্যবস্তু হলো সরু পথ ধরে দলবেঁধে এগিয়ে আসা শত্রুরা। ওরা আমাদের কাছাকাছি আসার আগেই প্রায় ত্রিশজনকে ঘায়েল করতে পারলাম আমরা।
এর পরেই নিজের রথ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম আমি। চালক এবার আমার রথটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল, আর আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দুই সঙ্গীর মাঝে ঢালটা সোজা করে ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। শত্রুর দিকে মুখ করে রইল আমার ঢাল।
প্রায় সাথে সাথেই হাজির হলো সেই প্রলয়ংকর মুহূর্ত, দুই পক্ষ লিপ্ত হলো মরণপণ যুদ্ধে। শত্রুসৈন্যরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ব্রোঞ্জের সাথে ব্রোঞ্জের সংঘর্ষে তীক্ষ্ণ শব্দে কেঁপে উঠল বাতাস। পরস্পরের সাথে নিজেদের ঢাল আটকে ধরেছে দুই দলের সৈন্যরা, সেই অবস্থায় একে অপরকে ঠেলে বা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকেই চাইছে প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফাটল ধরাতে। এ যেন এমন এক লড়াই, যেখানে কোনো বিকৃত যৌন মিলনের আসনের চাইতেও শারীরিকভাবে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছি আমরা। পেটের সাথে পেট, মুখের সাথে মুখ ঠেকিয়ে ঠেলছি একে অপরকে। গলা দিয়ে যখন নানা রকম চিৎকার বা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসছে তখন, তার সাথে আমাদের বিকৃত মুখ থেকে ছিটকে আসছে থুতু, গিয়ে লাগছে আমাদের চাইতে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকা শত্রুর মুখে। আমাদের দীর্ঘ অস্ত্রগুলো এই অবস্থায় ব্যবহার করার উপায় নেই, অনেক বেশি কাছাকাছি রয়েছে শত্রুরা। ব্রোঞ্জের ঢালগুলোর মাঝে আটকা পড়ে গেছি আমরা। এই অবস্থায় কেউ যদি পা ফসকে পড়ে যায় তাহলে তার অর্থ হবে দুই দলেরই সদস্যদের ব্রোঞ্জের স্যান্ডেলের নিচে ভয়ানকভাবে পিষ্ট হওয়া, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।