.
ভোরের প্রথম আলোয় আকাশ সোনালি হয়ে ওঠার আগেই আমাকে ডেকে তুলল আমার চাকররা। তাড়াহুড়োর সাথে যুদ্ধের পোশাক পরে নিলাম আমি, কোমরে বেঁধে নিলাম আমার তলোয়ার। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম রাজকীয় তাবুর দিকে। আরো একবার যখন ফারাওয়ের বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম, তখনো তার মুখে সেই হাসি খেলা করছে। কিন্তু আমার হাতের নিচে ঠাণ্ডা লাগল তার হাত, বুঝতে পারলাম মারা গেছেন তিনি।
তোমার জন্য পরে শোক করব আমি, আমার মেম, সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম আমি কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে, চেষ্টা করতে হবে তোমার কাছে, সেইসাথে আমাদের মিশরের প্রতি আমি যে শপথ করেছিলাম তা পালন করার।
দীর্ঘ জীবন পাওয়ার এই হলো অভিশাপ: যাদের তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো তাদের সবাইকে এক এক করে হারিয়ে যেতে দেখা।
আমাদের এলোমেলো সেনাদলের যা কিছু বাকি ছিল তারা সবাই সোনালি শহর লুক্সরের সামনে পথের শুরুতে এসে জড়ো হয়েছে। এখানেই গত পঁয়ত্রিশ দিন ধরে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে হিকসসদের রক্তপিপাসু বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছি আমরা। সৈন্যদের মুষ্টিমেয় দলগুলোর সামনে দিয়ে যুদ্ধ-রথ নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। আমাকে চিনতে পারার সাথে সাথে যারা যারা সক্ষম ছিল তারা সবাই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। ঝুঁকে নিজেদের আহত সঙ্গীকেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল তারা, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্থান নিল। তারপর সুস্থ ও সবল সৈন্যরা, সেইসাথে যেসব সৈন্য ইতোমধ্যে মৃত্যুর পথে অর্ধেক এগিয়ে গেছে তাদের সবাই ভোরের আকাশের দিকে নিজেদের অস্ত্র তুলে ধরল, আমি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অভিনন্দন জানাল আমাকে।
সুরেলা একটা ধ্বনি ভেসে আসতে শুরু করল: টাইটা! টাইটা! টাইটা!
মিশরের এই সাহসী সন্তানদের এমন করুণ পরিস্থিতিতে দেখে কোনোমতে চোখের পানি আটকে রাখলাম আমি। তার বদলে জোর করে হাসি ফোঁটালাম ঠোঁটে, হাসি আর চিৎকারের মাধ্যমে পাল্টা উৎসাহ দিলাম তাদের সবাইকে। সেনাদলের মাঝে পরিচিত মুখগুলোকে নাম ধরে ডাকলাম।
এই যে ওসমেন! জানতাম যে তোমাকে সামনের সারিতেই পাওয়া যাবে।
আপনার কাছ থেকে আমার দূরত্ব কখনো এক তলোয়ারের বেশি ছিল না প্রভু, আর হবেও না! সেও পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিল আমার কথার।
লোথান, ব্যাটা লোভী বুড়ো সিংহ। ইতোমধ্যে যথেষ্ট হিকসস কুকুর কুপিয়ে মেরেছ তুমি, আর কত?
যথেষ্ট মেরেছি ঠিক কিন্তু আপনি যতগুলো মেরেছেন তার অর্ধেকও পারিনি, প্রভু টাটা। লোথান আমার বিশেষ প্রিয়ভাজনদের একজন, তাই তাকে অনুমতি দিয়েছি আমার ডাকনাম ধরে সম্বোধন করার। সবার সামনে দিয়ে আমার রথ পার হয়ে যাওয়ার পর সৈন্যদের উচ্ছ্বাসধ্বনি নীরব হয়ে গেল, আরো একবার তার জায়গা দখল করল ভয়ংকর নীরবতা। আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সবাই, তাকিয়ে রইল উঁচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পথের শেষ প্রান্তের দিকে। সবাই জানে যে ওখানে হিকসস সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে, ভোরের আলো সম্পূর্ণ ফুটলেই আবার পুরোদমে আক্রমণ চালাবে তারা। আমাদের চারপাশের যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে আছে বিগত দিনগুলোর যুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষগুলোর লাশ। প্রত্যুষের হালকা বাতাসে অপেক্ষারত আমাদের কাছে বয়ে আনছে মৃত্যুর গন্ধ। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে সেই গন্ধ। টেনে নিচ্ছি আমি, মনে হচ্ছে যেন তেলের মতো ঘন হয়ে সেই গন্ধ লেগে থাকছে আমার জিভ আর গলার ভেতরে। বারবার গলা পরিষ্কার করে থুতু ফেলছি রথের পাশে, তবু প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে মনে হচ্ছে যেন আরো বেশি শক্তিশালী আর বিশ্রী হয়ে উঠছে গন্ধটা।
ইতোমধ্যে আমাদের চারপাশে ছড়ানো লাশগুলোর ওপর জুটে বসে ভোজে মেতেছে শব-খেকো পাখির দল। শকুন আর কাকেরা ধীর গতিতে চক্কর দিচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে, তারপর মাটিতে এসে নামছে। শেয়াল আর হায়েনাদের হট্টগোল আর চেঁচামেচিতে যোগ দিচ্ছে তারা, পচতে শুরু করা মানুষের মাংস টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে আস্ত গিলে নিচ্ছে। হিকসস তলোয়ারের সামনে পরাজয়ের পর এই একই পরিণতি আমার জন্যও অপেক্ষা করছে কথাটা ভাবতেই অনুভব করলাম ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে শরীরে।
থরথর করে কেঁপে উঠে চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম, চিৎকার করে ক্যাপ্টেনদের নির্দেশ দিলাম তীরন্দাজদের সামনে পাঠাতে। লাশগুলো থেকে যতগুলো সম্ভব তীর সংগ্রহ করে আনতে হবে, যাতে সবার খালি হয়ে আসা তূণ আবার ভরে নেওয়া যায়।
তারপর পাখি আর পশুদের হইচইয়ের তীক্ষ্ণ শব্দ ছাপিয়ে ঢাকের শব্দ ভেসে এলো আমার কানে, সামনের পথটার মাঝে প্রতিধ্বনি তুলল। আমার লোকেরাও সবাই শুনতে পেল সেই শব্দ। গলা ফাটিয়ে নির্দেশ ছুড়ল সার্জেন্টরা। যে কটা তীর পাওয়া গেছে তাই নিয়েই যুদ্ধের মাঠ থেকে তড়িঘড়ি করে ফিরে এলো তীরন্দাজরা। পেছনে থাকা সৈন্যরা এবার সামনে চলে এলো, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়াল তারা। প্রত্যেকের ঢাল ঠেকিয়ে রেখেছে পাশের জনের ঢালের সাথে। সবার তলোয়ারের ফলা আর বর্শার মাথা বহু। ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে গেছে ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায়। তবু সেগুলোই শত্রুর দিকে ফিরিয়ে রেখেছে তারা। তাদের ধনুকের যেখানে যেখানে ফেটে গেছে সেখানে সরু তার দিয়ে বাঁধা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুড়িয়ে আনা তীরগুলোর মাঝে অনেকগুলোতে অদৃশ্য হয়েছে পালক। তবে সন্দেহ নেই কাছাকাছি দূরত্বে এখনো ওগুলো সঠিকভাবেই কাজ করবে। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈনিক আমার লোকেরা, ক্ষতিগ্রস্ত অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি দিয়েও কী করে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনতে হয় তা ভালো করেই জানে।