গত কয়েক ঘণ্টা ধরে উপস্থিত সবাই ফারাওয়ের আগমনের অপেক্ষা করছিল। এবার উঠে দাঁড়াল সবাই, ফারাওয়ের সামনে এসে ঝুঁকে মার্বেল পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকাল। আমাদের সামনে সিংহাসনে বসল উটেরিক। তার দুই পাশে রইল সেই চাটুকারের দল। নিজেদের মাঝে খিক খিক করে হাসাহাসি করছে তারা। এমন সব কৌতুক করছে, যেগুলোর রস তারা ছাড়া আর কারো বোঝার সামর্থ্য নেই।
এরই মাঝে রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী এবং রাজপরিবারের সদস্যরাও হলঘরে প্রবেশ করল। ফারাওয়ের পেছনে পাথরের আসনে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আমার, অর্থাৎ অপরাধীর মুখোমুখিই বসল তারা।
এই উপস্থিত ব্যক্তিদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর উঁচু পদমর্যাদার অধিকারী হচ্ছে ফারাও টামোসের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র, সিংহাসনের প্রতি যার অধিকার সত্তাই উটেরিক টুরোর পরেই সবচেয়ে বেশি।
তার নাম রামেসিস। তার মা ছিল ফারাওয়ের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী, যার নাম রানি মাসারা। কিন্তু রামেসিসের জন্ম দেওয়ার আগে ছয়টা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিল সে। ওদিকে টামোসের অন্য আরেক স্ত্রী, যে তার অপেক্ষাকৃত কম প্রিয় হলেও একটি ছেলের জন্ম দেয়। সেই স্ত্রীর নাম ছিল সামোরতি, এবং তার মাত্র কয়েক মাস পরেই মাসারার গর্ভে জন্ম হয় রামেসিসের। কিন্তু প্রথম পুত্র এবং সেইসাথে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে জন্ম দেওয়ার সম্মান লেখা ছিল সামোরতির কপালে। সেই সন্তানই উটেরিক টুরো।
উপস্থিত সবার মাঝে অটুট নীরবতা বিরাজ করলেও উটেরিক টুরো আর তার সঙ্গীদের মাঝে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজেদের মাঝে হাসাহাসি আর কথাবার্তা চালিয়ে গেল তারা। আমি এবং আমার সঙ্গীদের দিকে কারো খেয়ালই নেই। অগত্যা আরো কিছুক্ষণ ফারাওয়ের উদ্ভট খেয়াল সহ্য করতে বাধ্য হলাম আমরা।
হঠাৎ করেই প্রথমবারের মতো আমার দিকে তাকাল ফারাও। চাবুকের মতো তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল তার কণ্ঠস্বর। এই বিপজ্জনক অপরাধীকে আমার সামনে আনা হয়েছে অথচ তার হাত বাঁধা হয়নি কেন?
সরাসরি ফারাওয়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু রেখেই জবাব দিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। হে মহাশক্তিমান অধিপতি… এমন তেলতেলে সম্বোধনে এর আগে কোনো ফারাওকে ডাকতে শুনিনি আমি। তবে পরে জেনেছিলাম কেউ যদি রাজকীয় ক্রোধের শিকার হতে না চায় তবে উটেরিক টুরোকে সম্বোধনের সময় এ কথাগুলোই তাকে ব্যবহার করতে হবে। …কয়েদিকে এখনো বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। তাই তাকে বেঁধে রাখার কথাও ভাবিনি আমি।
কী বললে? ভাবোনি? তা তো বটেই, তা তো বটেই। চিন্তাভবনা করার জন্য মাথার ভেতরে কিছুটা মগজ থাকা লাগে। খিক খিক করে হেসে উঠল ফারাওয়ের পায়ের কাছে জড়ো হওয়া চাটুকারের দল, হাততালি দিয়ে উঠল কেউ কেউ। ওদিকে ওয়েনেগের লোকদের মাঝ থেকে দুজন আমাকে উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থান থেকে উঠে বসতে বাধ্য করল, তারপর ডুগের কাছ থেকে নিয়ে আসা হাতকড়াগুলো পরিয়ে দিল আমার কবজিতে। তারা যখন ফারাওয়ের নির্দেশ পালন করছে, আমি খেয়াল করলাম যে লজ্জায় আমার দিকে তাকাতে পারছে না ওয়েনেগ। হাত বাঁধা শেষ হতে আবার চাপ দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে।
হঠাৎ করে সিংহাসন থেকে নেমে এলো ফারাও উটেরিক টুরো, আমার সামনে পায়চারি করতে শুরু করল। মাথা উঁচু করার সাহস পাচ্ছিলাম না আমি, ফলে তাকে দেখাও যাচ্ছিল না। কিন্তু মার্বেলের মেঝেতে তার জুতোর শব্দ ঠিকই শোনা যাচ্ছে। এবং শব্দটা শুনে বোঝা যাচ্ছ যে তার পায়চারির গতি বাড়ছে, ধীরে ধীরে খেপে উঠছে সে।
হঠাৎ করেই আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল ফারাও, এদিকে তাকাও, ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক শুয়োর!
সাথে সাথে ওয়েনেগের লোকদের মাঝে একজন এগিয়ে এসে আমার চুল মুঠো করে ধরল, তারপর টান দিয়ে মেঝেতে উঠে বসতে বাধ্য করল আমাকে। এবার মুখটা রইল ফারাওয়ের দিকে।
কী কুৎসিত ভয়াবহ আর লোভী একটা চেহারা! বলে উঠল উটেরিক। কিন্তু আরো একটা জিনিস ওখানে দেখতে পাচ্ছি আমি। একেবারে দিবালোকের মতো পরিষ্কারভাবে সমস্ত মুখ জুড়ে লেখা রয়েছে একটা কথা- অপরাধী! হলঘরে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলা হলো কথাটা। এবার আমার এবং আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এই হতভাগা যে অপরাধগুলো করেছে তার তালিকা তোমাদের জানানো হবে। তখন তোমরা বুঝতে পারবে এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছি তা কতটা উপযুক্ত। ডান হাতের তর্জনী আমার মুখের দিকে তাক করল সে, রাগে থরথর করে কাঁপছে। আমার জানা মতে এর প্রথম শিকার ছিলেন আমার দাদি রানি লসট্রিস। যদিও আমার ধারণা তার আগেও আরো অনেকের সর্বনাশ করেছে এই শয়তান।
না! না! রানি লসট্রিসকে আমি ভালোবাসতোম, তীব্র ক্ষোভে আর দুঃখে চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি, ওই নামটা শুনে কোনোভাবেই নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। তাকে আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম।
হয়তো সে কারণেই তাকে খুন করেছিলে তুমি। তার ভালোবাসা পাওনি, তাই আর কেউ যেন পেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করেছ। শুধু তাকে খুন করেই ক্ষান্ত হওনি, এই ঘৃণিত কাজের কথা গর্ব করে লিখে রেখেছ রানি লসট্রিসের সমাধির ভেতরে তোমার তৈরি করা পুঁথিতে। তোমার হাতে লেখা সেই কথাগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছিঃ সেথের সেই অভিশপ্ত চিহ্নকে খুন করেছি আমি, যা বেড়ে উঠেছিল তার গর্ভে।