তোমাকে টাকা দেব আমি, নিজের কণ্ঠস্বরে হতাশার আভাস পাচ্ছি।
আমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আপনার কাছে, মোটা কাঠের দরজা ভেদ করেও ভেসে এলো ডুগের কণ্ঠস্বর। তারপর তাদের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল, নীরব হয়ে গেল একসময়। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমি।
বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি নিজের চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা স্তর তৈরি করতে পারি। কিছু কিছু পোকামাকড়ের খোলস বা খুঁটি যেভাবে কাজ করে আমার এই প্রতিরক্ষা স্তরটাও ঠিক তেমন। এই সময় নিজের অনেক গভীরে এক নিরাপদ জায়গায় নিজেকে গুটিয়ে নিই আমি। এখনো আমি সেটাই করলাম।
২. বন্দিদশার তৃতীয় দিন
বন্দিদশার তৃতীয় দিন ভোরবেলায় আমাকে নিতে এলো ডুগ আর তার সহকারীরা। মনের অনেক গভীরে যেখানে আমি ডুব দিয়েছিলাম সেখান থেকে আমাকে তুলে আনতে বেশ কষ্ট করতে হলো তাদের। প্রথমে মনে হলো যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে তাদের কণ্ঠস্বর। আস্তে আস্তে অনুভব করলাম তাদের হাতগুলো জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে আমাকে, জুতোগুলো লাথি মারছে। তবে শুধু যখন টের পেলাম যে আমার মুখের ওপর এক বালতি পানি ছুঁড়ে মারা হয়েছে তখনই আমার পূর্ণ চেতনা ফিরে পেলাম আমি। দুই হাতে আঁকড়ে ধরলাম বালতিটা, তারপর তলায় যেটুকু পানি পড়ে ছিল তাই গলায় ঢেলে গিলে ফেললাম। যদিও আমার হাত থেকে বালতিটা কেড়ে নেওয়ার জন্য ডুগের তিন সহকারী কম চেষ্টা করল না, তবে লাভ হলো না কোনো। ওই কয়েক ঢোক নোংরা ঈষদুষ্ণ পানি যেন আমার জন্য নতুন জীবন বয়ে আনল। অনুভব করলাম আমার পানিশূন্য দেহে নতুন করে শক্তি বয়ে যাচ্ছে, আমার চেতনার দুর্গে নতুন করে প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে আমাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভোলা পিঠে বারবার চাবুক মারতে লাগল ডুগ; কিন্তু তাতে কোনো ক্ষেপই করলাম না আমি। একটু পরেই দিনের আলোতে খোলা বাতাসে বেরিয়ে এলাম আমরা। সত্যিই, যেই অন্ধকার কক্ষ থেকে আমাকে বের করে আনা হয়েছে তার তুলনায় এই বাতাস যেন গোলাপের সৌরভ; যদিও এখনো আমি কারাগারের ভেতরেই রয়েছি।
মাথার খুলিতে ভরা সেই প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলো আমাকে। দেখলাম রথ নিয়ে এখানে অপেক্ষা করছে ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই চমকে উঠে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে, আমার বিধ্বস্ত চেহারা আর শুকনো অবয়বের দিকে তাকাতে চাইছে না। তার বদলে হাতে ধরা প্যাপিরাসে নিজের হায়ারোগ্লিফ আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে ওই প্যাপিরাসে স্বাক্ষর করতে বলেছে ডুগ। কাজটা শেষ হতে ওয়েনেগের সঙ্গীরা আমাকে রথে উঠতে সাহায্য করল। যদিও আমি ব্যাপারটা ঢেকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি; কিন্তু এখনো আমি অনেক দুর্বল, টলে উঠছি মাঝে মাঝেই।
লাগামে টান দিল ওয়েনেগ, খোলা ফটকের দিকে ঘোরাল রথের মুখ। মুখে বীভৎস হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকাল ডুগ। হেঁকে বলে উঠল, আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকব আমি প্রভু। শুধু আপনার ওপর প্রয়োগ করার জন্যই কিছু নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি আমি। এবং আশা করি সেগুলো আপনার বেশ পছন্দ হবে।
পাহাড়ের পাদদেশে সেই ছোট্ট নালাটার কাছে এসে পৌঁছলাম আমরা। এই সময় লাগাম টেনে রথ থামাল ওয়েনেগ, তারপর হাত বাড়িয়ে আমাকে নামতে সাহায্য করল। আমাকে নালার কিনারে নিয়ে এলো সে।
নিজেকে নিশ্চয়ই একটু সাফসুতরো করে নিতে চাইবেন আপনি, প্রভু। ওয়েনেগও ডুগের মতোই আমাকে প্রভু বলে ডাকছে; কিন্তু তাতে ঠাট্টার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। আপনার সুন্দর পোশাকগুলোর কী হয়েছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আপনার জন্য নতুন একটা টিউনিক নিয়ে এসেছি আমি। এখন যে অবস্থায় আছেন এভাবে ফারাওয়ের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।
নালার পানি শীতল, সুস্বাদু। সারা শরীরে লেগে থাকা শুকনো রক্ত আর কারাকক্ষের ময়লা ধুয়ে ফেললাম আমি, তারপর পরিপাটি করে আঁচড়ে নিলাম আমার লম্বা, ঘন চুল। এগুলো আমার গর্বের বস্তু।
ওয়েনেগ ওই কারাগারে আগেও এসেছে, এবং নিশ্চয়ই জানে যে একবার ডুগের চোখে পড়ার পর আমার পোশাক এবং শিরস্ত্রাণের কী দশা হতে পারে। আর সে কারণেই আমার নগ্নতাকে আড়াল করার জন্য রথচালকদের জন্য তৈরি একটা নীল রঙের টিউনিক বা আঁটো পোশাক নিয়ে এসেছে সে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, পোশাকটা আমার অবয়বকে স্নান করার বদলে আরো ফুটিয়ে তুলল, কারণ পোশাকটা বেশ আঁটো হওয়ার কারণে আমার একহারা পেশিবহুল গড়ন একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাথে কোনো আয়না নেই, তা সত্ত্বেও ঝরনার পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। স্বাভাবিকভাবেই এটা আমার শ্রেষ্ঠ পোশাক নয়; কিন্তু এখনো একটা ব্যাপার নিয়ে আমি গর্ব করতেই পারি। এমনকি ফারাওয়ের দরবারেও অন্তত চেহারা সুরতে আমার ওপর টেক্কা দিতে পারে এমন খুব বেশি মানুষ নেই।
ওয়েনেগ আমার জন্য পানীয় আর খাবারও নিয়ে এসেছে: রুটি আর নীলনদ থেকে ধরা ঠাণ্ডা মাছ। তার সাথে এক পাত্র বিয়ার। দারুণ সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর মনে হলো খাবারটা। অনুভব করলাম আমার সমস্ত শরীরে নতুন করে শক্তির স্রোত বইতে শুরু করেছে। এবার রথে উঠে ফারাওয়ের প্রাসাদের দিকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। প্রাচীরঘেরা লুক্সর শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত ফারাওয়ের প্রাসাদ। আজ ঠিক দুপুরে আমার বিচার শুরু হওয়ার কথা, তবে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই প্রাসাদের কেন্দ্রীয় হলঘরে প্রবেশ করলাম আমরা। ফারাও এবং তার সঙ্গীদের দেখা পেতে অবশ্য দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগল। এবং এক নজরেই বোঝ গেল সবাই কড়া মদ টানছিল এতক্ষণ, বিশেষ করে আমাদের ফারাও। লাল হয়ে আছে তার মুখ, কথায় কথায় হেসে উঠছে হো হো করে। হাঁটছে টলোমলো পায়ে।