সঙ্গীদের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল ডুগ। সাথে সাথে আমার মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা খুলে নিল তারা, গলা থেকে সরিয়ে নিল সোনার হারগুলো। আমার শরীরে যে সুন্দর পোশাক ছিল তাও খুলে নেওয়া হলো, ফলে ছোট্ট এক টুকরো কাপড় বাদে প্রায় উলঙ্গ হয়ে পড়লাম আমি। সব শেষে আমাকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করানো হলো, তারপর জোর করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো খোলা জায়গাটুকুর অপর পাশে অবস্থিত দরজাগুলোর দিকে।
আমার পাশে পাশে চলতে লাগল ডুগ। এই কারাগারের প্রাচীরের ভেতর আমরা যারা চাকরি করি তারা সবাই ফারাও উটেরিক টুরোর সিংহাসনে আরোহণ নিয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। নিজের উত্তেজনার পরিমাণ বোঝাতে চার পাঁচবার চোখ টিপল সে, প্রতিবার চোখ টেপার সময় ঝাঁকি খেল মাথাটা। ফারাও আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন, মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন আমাদের। ফারাও টামোসের রাজত্বের সময় সপ্তাহে এক-আধবার আমাদের ডাক পড়ত। কিন্তু এখন তার বড় ছেলে আমাদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত রেখেছেন। সব সময়ই হয় কারো মাথা কেটে ফেলা, না হলে পুরুষ এবং মহিলাদের পেট থেকে নাড়িভুড়ি টেনে বের করে আনা; অথবা তাদের হাত-পা ভেঙে ফেলা, অথবা তাদের গলায় বা অণ্ডকোষে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া; অথবা গরম লোহার শিক দিয়ে চামড়া তুলে ফেলা- ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আমাদের। খুশি খুশি গলায় হেসে উঠল সে। এক বছর আগেও আমার ভাই এবং আমার পাঁচ ছেলের হাতে কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু এখন তারা আমার মতোই পেশাদার অত্যাচারকারী এবং জল্লাদ। কয়েক সপ্তাহ পর পরই লুক্সরের রাজপ্রাসাদে আমাদের ডেকে পাঠান ফারাও উটেরিক টুকরা। আমরা যখন আমাদের দায়িত্ব পালন করি সেটা দেখতে ভালোবাসেন তিনি। যদিও তিনি এখানে কখনো আসেননি। তার বদ্ধমূল ধারণা, এই দেয়ালগুলোর ওপর কোনো একটা অভিশাপ আছে। এখানে যারা আসে তাদের নিয়তিতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু লেখা থাকে না। আর সেই মৃত্যুকে ডেকে আনার কাজটা করি আমরা। তবে আমি যখন কমবয়সী মেয়েগুলোর ওপর আমার দক্ষতা ফলাই তখন সেটা দেখতে খুব ভালোবাসেন ফারাও, বিশেষ করে তারা যদি গর্ভবতী হয়। তাই এমন কাউকে পাওয়া গেলে তাদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাই আমরা। আমার ছোট্ট একটা শখ হচ্ছে, ওদের স্তনের মাঝে ব্রোঞ্জের হুক আটকে ঝুলিয়ে রাখা, সেইসাথে আরো একটা হুক দিয়ে ওদের পেট থেকে জ্বণটা ছিঁড়ে বের করে আনা। নিজের বর্ণনা শুনে নিজেই ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো লালা ফেলতে শুরু করেছে লোকটা। এমন বীভৎস সব কাজের কথা শুনে বমি করে দিতে ইচ্ছে হলো আমার।
আপনার পালা আসতে এখনো সময় লাগবে, তবে ততক্ষণ আমার কাজের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পাবেন আপনি। এমনিতে আমি এসব ক্ষেত্রে একটা ফি রাখি, তবে আপনি যেহেতু আপনার শিরস্ত্রাণ আর সোনার হারগুলো আমাকে রাখতে দিয়েছেন, আপনার কাছে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ… আমার দেখা সবচেয়ে ঘৃণিত লোকগুলোর মাঝে এই লোকটা অন্যতম। যে কালো পোশাক সে পরে আছে সেটা নিঃসন্দেহে তার শিকারদের রক্তের দাগ গোপন করার জন্য। কিন্তু অনেক বেশি কাছাকাছি থাকায় আমি দেখতে পাচ্ছি যে, কিছু কিছু দাগ এখনো ভেজা। যে দাগগুলো শুকিয়ে গেছে সেসব জায়গায় পচন ধরেছে। কাপড়ে। লোকটার পুরো শরীরে চারপাশে যেন ভারী হয়ে ঝুলে আছে মৃত্যু আর পচনের দুর্গন্ধ, ঠিক যেমন জলাভূমির ওপর ঝুলে থাকে সঁতসেঁতে কুয়াশার চাদর।
জেলখানা নামের এই নরককুণ্ডের মাঝ দিয়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে ভুগের সহকারীরা। আশপাশে সবাই তাদের বীভৎস দায়িত্ব পালন করতে ব্যস্ত। রুক্ষ পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলেছে তাদের শিকারের কাতর আর্তনাদ, মিশে যাচ্ছে পেশাদার নিপীড়নকারীদের চাবুকের তীক্ষ্ণ শব্দ আর খিক খিক হাসির সাথে। তাজা রক্ত আর মানুষের মলমূত্রের গন্ধ এত ভয়ানকভাবে বাতাসে মিশে আছে যে, দম বন্ধ হয়ে এলো আমার, একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য খাবি খেতে লাগলাম।
একসময় একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম আমরা। নিচে রয়েছে একটা ছোট্ট জানালাবিহীন ভূগর্ভস্থ কামরা। একটামাত্র মোমবাতি জ্বলছে সেখানে, আর কিছুই নেই। কামরাটা এত ছোট যে হাঁটুগুলো থুতনির নিচে নিয়ে এসে একটু বসতে পারব আমি, তার চেয়ে বেশি কোনো জায়গা নেই। ঠেলেঠুলে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো আমাকে।
আজ থেকে তিন দিন পর ফারাও আপনার বিচার করবেন। তখন আপনাকে নিতে আসব আমরা। তা ছাড়া আপনাকে কোনোভাবেই বিরক্ত করা হবে না, নিশ্চিত থাকুন, আমাকে আশ্বস্ত করল ডুগ।
খাবার চাই আমার, সেইসাথে পান করা এবং নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য বিশুদ্ধ পানি, প্রতিবাদ করলাম আমি। বিচারের দিন পরার মতো কিছু পরিষ্কার কাপড়ও দরকার।
কয়েদিরা সাধারণত এসব ব্যাপার নিজেরাই জোগাড় করে নেয়। আমরা ব্যস্ত মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না যে এসব সামান্য বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাব? ব্যঙ্গের হাসি হেসে এক ফুঁ দিয়ে মোমটা নিভিয়ে দিল ডুগ, তারপর মোমের বাকি অংশটুকু নিজের আলখাল্লার মাঝে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর দড়াম করে আমার কামরার দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। ওপাশ থেকে তালায় চাবি ঢোকানোর শব্দ শুনতে পেলাম আমি। এই বদ্ধ নোংরা পাথরের ঘরটায় তিনটি দিন কাটাতে হবে আমাকে, কোনো খাবার এবং পানি ছাড়া। জানি না তিন দিন পর আমি বেঁচে থাকব কি না।