প্রতিটি তাকে রয়েছে একটা করে দাঁত বের করে থাকা মাথার খুলি। শত শত খুলি চোখে পড়ল আমার। অবশ্য এখানে এটাই আমার প্রথমবার আসা নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এখানে বন্দি হওয়া হতভাগ্য কিছু লোকের সাথে দেখা করতে আসতে হয়েছে আমাকে, চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব তাদের সাহায্য করার, স্বস্তি দেওয়ার। তার পরেও চারপাশে মৃত্যুর এমন ভয়াবহ প্রমাণ, খোলাখুলি উপস্থিতি দেখে প্রতিবারই ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছে আমার ভেতরটা। আর এবার সেটা আরো বেশি ঘটল, কারণ বিপদটা এখন আমার নিজের।
এর চেয়ে বেশি দূরে আমার যাওয়ার অনুমতি নেই, প্রভু টাইটা, মৃদু স্বরে বলল ওয়েনেগ। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি শুধু আমার ওপরে থাকা হুকুম পালন করছি। আপনার সাথে আমি যা করেছি তাতে ব্যক্তিগত কোনো কারণ নেই, এবং কাজটা করতে আমার মোটেই ভালো লাগেনি।
আমি তোমার সমস্যা বুঝতে পেরেছি ক্যাপ্টেন, জবাব দিলাম আমি। আশা করি এরপরে যখন আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে, উভয়ের জন্যই অনেক বেশি আনন্দের হবে।
এবার আমাকে রথের পাদানি থেকে নামতে সাহায্য করল ওয়েনেগ, তারপর ছুরির এক পোচে আমার হাতের বাঁধন কেটে মুক্ত করে দিল। কারারক্ষীদের কাছে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতাটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দিল সে, আমার শাস্তিসংক্রান্ত প্যাপিরাসগুলো তুলে দিল তাদের হাতে। প্যাপিরাসের নিচে ফারাও উটেরিকের হায়ারোগ্লিফ প্রতীক চিনতে পারলাম আমি। তারপর আমাকে স্যালুট করল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, এবং ঘুরে দাঁড়াল। আমার চোখের সামনে এক লাফে রথে উঠে পড়ল সে, তারপর লাগামটা হাতের মুঠোয় নিয়ে রথ ঘুরিয়ে দরজার দিকে ফিরল। ঝুলন্ত দরজাটা যথেষ্ট পরিমাণ ওপরে উঠতেই তীরবেগে বাইরে বেরিয়ে গেল ওয়েনেগের রথ, একবারও পেছনে তাকাল না সে।
চার কারারক্ষী এগিয়ে এলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওয়েনেগ বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই চারজনের মাঝে একজন তার মাথার কালো কাপড়টুকু সরিয়ে ফেলল, তারপর বীভৎস হাসি মুখে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটা বিচ্ছিরি রকমের মোটা শরীরের অধিকারী, গলার নিচ থেকে কয়েক পরত চর্বি ঝুলে পড়েছে বুক বরাবর।
আপনাকে পেয়ে আমরা সম্মানিত বোধ করছি, হে প্রভু। এমন বিখ্যাত উচ্চপদস্থ আর ধনী ব্যক্তির খেদমত করার সৌভাগ্য তো আমাদের সব সময় হয় না। সম্পদের দিক দিয়ে ফারাওয়ের পরেই নাকি আপনার অবস্থান। আপনাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে চাই না আমি। প্রথমেই আমার পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমার নাম ডুগ। চকচকে টাকসহ বিশাল মাথাটা নুইয়ে সম্মান দেখানোর ভঙ্গি করল সে। টাক মাথার পুরোটা জুড়ে আঁকা রয়েছে কুরুচিপূর্ণ উল্কি; এক দল কাঠের পুতুল পরস্পরের সাথে এমন সব কাজ করছে, যা দেখলে বমি আসতে বাধ্য। কিন্তু লোকটার কথা থামেনি। বলে চলেছে: আপনার মতো জ্ঞানী এবং শিক্ষিত ব্যক্তি নিশ্চয়ই খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে ডুগ হচ্ছে গুড কথাটার ঠিক উল্টো, এবং বোঝার সাথে সাথে জেনে যাবেন যে আমার কাছ থেকে কী আশা করা যায়। আমাকে যারা ভালোভাবে চেনে তারা প্রায়ই আমাকে শয়তান ডুগ বলে ডাকে। ডুগের কোনো একটা স্নায়ুঘটিত সমস্যা আছে, যার কারণে প্রতিটা বাক্যের শেষে দ্রুত কয়েকবার ডান চোখের পাতা ফেলে সে। লোভ সামলাতে পারলাম না আমি, পাল্টা চোখ টিপলাম।
হাসি মুছে গেল তার মুখ থেকে। ঠাট্টা-তামাশা করতে খুব মজা লাগে আপনার, তাই না? ঠিক আছে, তামাশা আমিও জানি। আপনাকে এমন হাসি হাসাব, পেট ফেটে মরবেন, প্রতিশ্রুতি দিল সে। কিন্তু সেই মজাটা পেতে হলে আমাদের দুজনকেই একটু অপেক্ষা করতে হবে। ফারাও আপনাকে রাজদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করেছেন ঠিকই, কিন্তু এখনো আপনার বিচার হয়নি, আপনি দোষী প্রমাণিত হননি। যাই হোক, সেই সময় অবশ্যই আসবে। কথা দিচ্ছি, তখন প্রস্তুত থাকব আমি।
আমাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করল সে; কিন্তু আমিও একই গতিতে ঘুরে তার মুখোমুখি হয়ে রইলাম। একে শক্ত করে ধরে রাখো! সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে হিসিয়ে উঠল ডুগ। খপ করে আমার দুই হাত চেপে ধরল ওরা, তারপর চাপ দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করল।
আপনার পোশাকগুলো খুব সুন্দর প্রভু টাইটা, মন্তব্য করল ডুগ। এমন দারুণ জিনিস খুব কমই দেখেছি আমি। কথাটা সত্যি, কারণ আমি মনে মনে আশা করছিলাম যে হিকসসদের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্পদ সরাসরি ফারাও এবং তার পারিষদের কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমার মাথায় রয়েছে একটা সোনালি শিরস্ত্রাণ, অনেক আগে যুদ্ধক্ষেত্রে এক হিকসস সেনাপতির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম এটা। সোনা আর রুপোয় তৈরি এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। আমার কাঁধে ঝুলছে স্বর্ণসাহস আর স্বর্ণপ্রশংসার পদক, তার সাথে একই রকম উজ্জ্বল রঙের সোনালি কণ্ঠহার, যেগুলো ফারাও টামোস নিজ হাতে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। তার প্রতি আমার ত্যাগ ও সেবার নিদর্শন এগুলো। আমি জানি এই অবস্থায় আমাকে সত্যিই অসাধারণ লাগছে দেখতে। এমন সুন্দর পোশাককে কোনোভাবেই ময়লা বা নষ্ট হতে দিতে পারি না আমরা। এখনই খুলে ফেলুন ওগুলো। সব আমি আমার নিজের জিম্মায় রেখে দেব, বলল ডুগ। তবে সেইসাথে এটাও বলে রাখছি, আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর আপনি মুক্ত হলেই এগুলো সব ফিরিয়ে দেব। আমি শুধু নীরবে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, আমার প্রতিবাদ বা মিনতি শুনে তৃপ্তি লাভ করার কোনো সুযোগ দিতে রাজি নই। আমার লোকেরা আপনাকে পোশাক খুলতে সাহায্য করবে, বলে নিজের ছোট্ট বক্তৃতার ইতি টানল ডুগ। আমি নিশ্চিত দেয়ালের তাকগুলোতে যে লোকগুলো এখন খটখটে খুলি হয়ে ঝুলে আছে তাদের সবাইকেও সে এই একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।