যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর রাত নেমে এলো। দাসদের সাহায্যে আমার ঢাল এবং বর্ম থেকে তাজা রক্তের দাগ পরিষ্কার করে নিলাম আমি, সেইসাথে হেলমেটের দেবে যাওয়া জায়গাটাও পিটিয়ে ঠিক করে নিলাম। আজ সকালেই একটা। হিকসস তলোয়ারের আঘাত ঠেকিয়েছে এই হেলমেট। হেলমেটের পালকটা এখন আর নেই, কেটে পড়ে গেছে ওই একই আঘাতে। কাজ শেষ হতে মশালের কম্পমান আলোয় আমার পালিশ করা ব্রোঞ্জের হাত-আয়নায় নিজের চেহারার প্রতিফলন পরীক্ষা করে দেখলাম। বরাবরের মতোই এটা আমার ভেঙে পড়া মনকে একটু হলেও চাঙ্গা করে তুলল। আরো একবার আমার মনে পড়ল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়তে যাচ্ছে জেনেও সৈন্যরা কীভাবে একটা ধারণা বা নামকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম, চোখের নিচে জমাটবাঁধা বিষণ্ণ কালো ছায়াগুলোকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছি। তারপর তাঁবুর দরজার মাঝ দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে এসে এগিয়ে গেলাম আমার প্রিয় ফারাওয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
নিজের অসংখ্য সন্তানের মাঝ থেকে ছয় ছেলে এবং তিনজন চিকিৎসকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে আছেন ফারাও টায়োস। তাদের পরে আরো বড় একটা বৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে তার জেনারেল এবং একান্ত পরামর্শকরা, তাদের সাথে তার পাঁচজন প্রিয় স্ত্রী। সবার চেহারা বিষণ্ণ, কাঁদছে কেউ কেউ। কারণ মারা যাচ্ছেন ফারাও। দিনের শুরুর দিকেই যুদ্ধক্ষেত্রে এক ভয়ানক আঘাতের শিকার হয়েছেন তিনি। তার পাঁজরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা হিকসস তীরের অবশিষ্টাংশ। ফারাওয়ের যেসব চিকিৎসক এখানে উপস্থিত তারা কেউই তার হৃৎপিণ্ডের এত কাছ থেকে তীরের বাঁকানো মাথাটা বের করে আনতে সাহস পায়নি, এমনকি তাদের মাঝে যে সবচেয়ে দক্ষ সেই আমিও না। আমরা শুধু ক্ষতের মুখের কাছ থেকে তীরের গোড়াটা ভেঙে এনেছি এবং এখন অপেক্ষা করছি সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির। এটা প্রায় নিশ্চিত যে আগামীকাল দুপুরের আগেই ফারাও তার সোনালি সিংহাসন ছেড়ে দেবেন তার বড় ছেলে উটেরিক টুরোর হাতে। তার ছেলে এখন ফারাওয়ের পাশে বসে আছে, বোঝা যাচ্ছে যে মিশরের শাসনভার নিজের হাতে চলে আসার মুহূর্ত উপস্থিত হওয়ায় অনেক কষ্টে নিজের আনন্দটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে সে। উটেরিক একজন খামখেয়ালি এবং অপদার্থ যুবক, এটা কল্পনাই করতে পারছে না যে আগামীকাল সূর্য ডোবার সময় তার সাম্রাজ্যের হয়তো কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অন্তত সেই সময়ে আমি তার সম্পর্কে এটাই ভাবছিলাম। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমি জানতে পারব যে তাকে বিচার করতে কত বড় ভুল হয়েছিল আমার।
টামোস এখন একজন বৃদ্ধ মানুষ। নিখুঁতভাবে তার বয়স জানা আছে আমার, এমনকি ঘণ্টার হিসাবও বলতে পারব; কারণ এই কঠিন পৃথিবীতে নবজাতক ফারাওয়ের জন্ম নেওয়ার সময় আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জনপ্রিয় কিংবদন্তি আছে, তিনি জন্মের পর প্রথম যে কাজটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে আমার গায়ে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব করে দেওয়া। পরবর্তী ৬০ বছরে সেই একইভাবে আমার প্রতি নিজের বিরক্তি প্রকাশ করতে কখনো একটুও দ্বিধা বোধ করেননি তিনি, কথাটা মনে পড়তে এই দুঃখের মাঝেও হাসি চাপতে হলো আমাকে।
এবার তিনি যেখানে শুয়ে আছেন সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তার হাতে চুমু খেলাম। সত্যিকার বয়সের চাইতেও অনেক বেশি বয়স্ক লাগছে ফারাওকে। যদিও কিছুদিন আগে নিজের চুল আর দাড়িতে রং করিয়েছিলেন তিনি, আমি জানি যে তার পছন্দের উজ্জ্বল তামাটে রঙের নিচে চুলগুলো সব সূর্যের তাপে পোড়া শেওলার মতো ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। মুখের চামড়ায় অজস্র গভীর বলিরেখা, তার সাথে রোদে পোড়া ফুটকি ফুটকি দাগ। দুই চোখের নিচে ফুলে আছে চামড়া, চোখগুলোতে আসন্ন মৃত্যুর চিহ্ন সুস্পষ্ট।
নিজের বয়স সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও নেই আমার। তবে এটা ঠিক যে, ফারাওয়ের চাইতে আমার বয়স অনেক বেশি; যদিও চেহারা দেখলে মনে হতে পারে যে আমার বয়স তার স্রেফ অর্ধেক। এর কারণ হলো আমি একজন দীর্ঘজীবী মানুষ এবং দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট- বিশেষ করে দেবী ইনানার আশীর্বাদ আছে আমার ওপর। ইনানা হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের এক গোপন নাম।
মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন ফারাও। কথা বলতে ব্যথা পাচ্ছেন, কষ্ট হচ্ছে তার। কণ্ঠস্বর খসখসে হয়ে আছে। নিঃশ্বাসে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, অনেক কষ্টে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। টাটা! ছোটবেলায় আমাকে আদর করে যে নাম। দিয়েছিলেন সেই নাম ধরেই ডাক দিলেন তিনি। আমি জানতাম যে তুমি আসবে। তোমাকে কখন আমার সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা বুঝতে কখনো অসুবিধা হয়নি তোমার। বলো হে প্রিয় বন্ধু আমার, আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে?
আগামীকালের মালিক তো আপনি এবং মিশর, মহান প্রভু আমার। জানি না কেন তার কথার জবাবে ঠিক এ কথাগুলোই কেন বেছে নিলাম আমি, যখন এটা প্রায় নিশ্চিত যে আমাদের সবার ভবিষ্যই এখন কবরস্থান আর মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দেবতা আনুবিসের হাতে। তবু আমার ফারাওকে আমি ভালোবাসি এবং চাই যে যতটা সম্ভব শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করার সুযোগ পান তিনি।
মৃদু হাসলেন ফারাও, আর কোনো কথা বললেন না। তবে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দুর্বল আঙুলগুলো দিয়ে আমার হাত ধরলেন তারপর নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলেন যতক্ষণ না ঘুম নেমে এলো তার চোখে। চিকিৎসক এবং তার ছেলেরা এক এক করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। শপথ করে বলতে পারি, দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে উটেরিক টুরোর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখলাম আমি। মধ্যরাতের অনেক পরেও টামোসের সাথে বসে রইলাম আমি, ঠিক যেমনটা ছিলাম তার মায়ের মারা যাওয়ার সময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সারা দিনের যুদ্ধের পর আগত অপরিসীম ক্লান্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম। ফারাওয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আমি, তখনো সেই হাসি লেগে আছে তার মুখে। কোনোমতে টলতে টলতে নিজের কম্বলের কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি, তারপর মৃত্যুর মতো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গেলাম তার ওপর।