তবে চারপাশে মানুষের ভিড় এবং সেই সময়ে তৈরি হওয়া উত্তেজনার কারণে আমি একটা ব্যাপার খেয়ালই করিনি। কখন যেন প্রাসাদ প্রহরীদের ছয়জন উচ্চপদস্থ সদস্য ঘাটের জনসমুদ্রের মাঝ থেকে আমার জাহাজে উঠে এসেছে। কোনো রকম ঝামেলা বা হইচই ছাড়াই বৰ্ম আর খোলা অস্ত্র দিয়ে তৈরি এক নিশ্চিদ্র দেয়ালের মাঝে আমাকে ঘিরে ফেলল তারা।
প্রভু টাইটা, ফারাওয়ের একান্ত নির্দেশে আপনাকে রাজদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দয়া করে আমার সাথে আসুন, প্রহরীদের নেতা মৃদু কিন্তু শক্ত গলায় আমার কানে কানে বলল কথাগুলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। এ যে সেই ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, যার জন্য আমার মনে আলাদা একটা জায়গা আছে- এটা বুঝতে আমার এক মুহূর্ত সময় লেগে গেল।
কী সব বাজে কথা বলছ ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ? আমাকে তুমি ফারাওয়ের সবচেয়ে অনুগত প্রজা বলে ধরে নিতে পারো, অপমানিত গলায় প্রতিবাদ জানালাম আমি। কিন্তু আমার আপত্তিতে কান দিল না সে, শুধু সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝকাল একবার। সাথে সাথে সবাই আমাকে এমনভাবে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল, একটুও নড়ার উপায় রইল না আমার। অনুভব করলাম পেছন থেকে একজন আমার তলোয়ারটা বের করে নিল খাপ থেকে। জাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনা হলো আমাকে। সেই একই মুহূর্তে উপস্থিত বাদকদের দিকে হাত দিয়ে একটা ইশারা করল মেনাক্ট। ফলে সাথে সাথে নতুন একটা বাজনা শুরু হয়ে গেল, দেবোপম ফারাওয়ের প্রশংসা এবং প্রশস্তি বর্ণনা করা হতে লাগল তার তালে তালে। সেই শব্দে ঢাকা পড়ে গেল আমার প্রতিবাদ। জাহাজ থেকে আমাকে যখন পাথরের ঘাটে নামিয়ে এনেছে প্রহরীরা ততক্ষণে জনতার ভিড় ঘুরে গেছে বাদকদের দিকে। তাদের পিছু নিয়ে সম্পদবোঝাই গাড়িগুলো যেদিকে গেছে সেদিকে অর্থাৎ শহরের প্রধান দরজা অভিমুখে এগোতে শুরু করেছে তারা।
.
আমরা একাকী হয়ে পড়ার সাথে সাথেই প্রহরীদের নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। চামড়ার দড়ি দিয়ে আমার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হলো। দলের বাকিরা চারটে যুদ্ধের রথ নিয়ে এলো। আমাকে শক্ত করে বাঁধার পর ঠেলেঠুলে সবচেয়ে সামনের রথটার পাদানিতে উঠিয়ে দিল তারা। তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল চাবুক, রওনা হয়ে গেলাম আমরা। তবে বাদকদল আর সম্পদবোঝাই গাড়িগুলো যে পথে গেছে সেদিকে নয়, বরং শহরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা বিকল্প পথের দিকে। সেই পথ দিয়ে কিছু দূর এগোনোর পর দূরের পাথুরে পাহাড়গুলোর দিকে এগোতে শুরু করল আমাদের রথগুলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই পথটা তেমন ব্যবহার করা হয় না। সত্যি কথা বলতে শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ অংশ একান্ত ঠেকায় না পড়লে এই পথে কখনো আসে না। অবশ্য পথটা কোথায় গিয়ে থেমেছে সেটা বিবেচনা করলে এমনটাই স্বাভাবিক। রাজপ্রাসাদ এবং শহরের প্রাচীর থেকে পাঁচ লিগেরও কম দূরত্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা নিচু পর্বতমালা। সেই পাহাড়গুলোর মাঝে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার মাথায় বসে আছে ভয়াল চেহারার এক পাথুরে দালান। পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে ভবনটা, একেবারেই কর্কশ আর নিষ্প্রাণ চেহারা। রংটা কেমন যেন বিষণ্ণ নীলাভ। এই হচ্ছে লুক্সরের রাজকীয় কারাগার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ফাঁসিকাঠ এবং কেন্দ্রীয় অত্যাচার কক্ষগুলোও এখানেই অবস্থিত।
পাহাড়শ্রেণির গোঁড়ায় পৌঁছানোর জন্য ছোট একটা নালা পার হওয়া লাগল আমাদের। নালার ওপরে সেতুটা বেশ সরু, ঘোড়ার খুরে জোরালো শব্দ তৈরি হলো সেখানে। আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সেই শব্দকে মনে হতে লাগল মৃত্যুর এগিয়ে আসার পদধ্বনির মতো। কারাগারের একমাত্র ফটক, যার নাম দুর্দশার দরজা; সেখানে আসার আগ পর্যন্ত কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না আমাদের দিকে। দরজার সামনে থেমে লাফ দিয়ে আমাদের রথ থেকে নেমে পড়ল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, তলোয়ারের বাঁট দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারল দরজার ওপর। প্রায় সাথে সাথেই আমাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ দরজার ওপর এসে হাজির হলো কালো পোশাক পরা এক কারারক্ষী। তার মাথাতেও একই রকমের কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে, ফলে চোখ আর মুখ বাদে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কে ঢুকতে চায় ভেতরে? চিৎকার করে প্রশ্ন ছুড়ল সে।
কয়েদি আর তার রক্ষী! জবাব দিল ওয়েনেগ।
তাহলে নিজ দায়িত্বে প্রবেশ করো, সাবধান করে দিল কারারক্ষী। কিন্তু জেনে রেখো, ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করার পর চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দে ওপরে উঠে গেল। রথ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। তবে কেবল আমরাই ভেতরে ঢুকলাম, আমাদের পাহারা দিয়ে বাকি যে তিনটি রথ এসেছিল তারা বাইরেই রয়ে গেল। তাদের সামনেই আবার ঘড়ঘড় শব্দে নেমে এলো ভারী ঝুলন্ত দরজা।
ভেতরে ঢোকার পর প্রথম যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে: ছোট্ট একটা ভোলা জায়গাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আকাশছোঁয়া দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অনেক ওপরে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে চারকোনা আকাশ। সেটা দেখার জন্য ঘাড় অনেকখানি কাত করে ওপরে তাকাতে হলো আমাকে। দেয়ালগুলোর গায়ে অজস্র সারি সারি তাক বা কুলুঙ্গি।