একাকী বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
.
তিন দিন পর আমি আমার নিজের জাহাজে উঠলাম। দক্ষিণ দিকে রওনা দিলাম আমরা, গন্তব্য এবার সেই সোনালি শহর লুক্সর, যেখানে আমাদের বাড়ি। কিন্তু আমার মনটা এখনো ভারী হয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন বাতাস আর দাঁড়ের টান আমাকে যেদিকে নিয়ে চলেছে তার উল্টোদিকে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে গেছে আমার হৃদয়।
লুক্সরের শহরের গোড়ায় অবস্থিত বন্দরে যখন আমরা পৌঁছলাম, বোঝা গেল মেফিসে আমাদের বিশাল বিজয়ের খবর ইতোমধ্যে পত্রবাহী পায়রার মাধ্যমে ফারাও উটেরিকের প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। মনে হচ্ছে যেন পুরো মিশরের জনগণ এসে হাজির হয়েছে বন্দরে এত ভিড়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাওয়ের প্রধান প্রধান তিনজন মন্ত্রী। জনতার ভিড়ের পেছনে দেখা যাচ্ছে। কমপক্ষে বিশটি মালবাহী গাড়ি, প্রতিটা টানার জন্য রয়েছে বারোটা করে ষাঁড়। আন্দাজ করলাম এগুলো রাখা হয়েছে হিকসসদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্পদ বয়ে নিয়ে ফারাওয়ের কোষাগার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। সন্দেহ নেই এই সম্পদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কোষাগার। হার্প, বাঁশি, ট্রাম্পেট, তাম্বুরিন এবং ঢাকের মিলিত শব্দ শোনা যাচ্ছে, ফারাও উটেরিক ঢুরোর সম্মানে রচিত নতুন একটা গানের তালে বাজনা বাজাচ্ছে। তারা। গুজব ছড়িয়েছে গানটা নাকি সে নিজেই লিখেছে। উপস্থিত জনতা খুব রাখেনি। এখন সেগুলো মাথার ওপরে তুলে প্রবল উৎসাহে জোরে জোরে নাড়ছে তারা, সেইসাথে বাদকদের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইছে।
প্রধান ঘাটে বাঁধা হলো আমার জাহাজটা। মনে মনে ফারাও উটেরিক টুরো এবং সেইসাথে উপস্থিত বিপুল জনতার কাছ থেকে প্রশংসা এবং আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম আমি। মিশরকে খামুদি আর তার উপজাতির ভয়ানক সদস্যদের হাত থেকে বাঁচানো, সেইসাথে শত্রুদের খপ্পর থেকে এই অপরিমেয় সম্পদ উদ্ধার করার পর এমনটাই তো স্বাভাবিক।
উটেরিকের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে সুদর্শন এক যুবক, ক্রীতদাস ব্যবসায় বিশাল লাভবান হয়েছে সে। তার নাম হচ্ছে মেনাক্ট। ফারাওয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও সহযোগী সে। এবং শুধু ঘনিষ্ঠ বললে ভুল হবে, কারণ তাদের ঘনিষ্ঠতা মানসিক পর্যায় থেকে অনেক আগেই শারীরিক পর্যায়েও গড়িয়েছে। গুজব শুনেছি আমি, তাদের দুজনের মাঝেই নাকি ওই ধরনের কামুক মনোবৃত্তি আছে। তার ভাষণটা সম্ভবত কোনো কেরানি লিখে দিয়েছে, কারণ সেটা একেবারেই একঘেয়ে কণ্ঠে পড়ে গেল সে, একটু বড় শব্দ পড়তে গেলেই হোঁচট খেল বারবার। এতে হয়তো আমি তেমন কিছু মনে করতাম না; কিন্তু তার ভাষণটা শোনার সাথে সাথে একটা ব্যাপার বেশ বড় রকমের খটকা জাগিয়ে তুলল আমার মনে। হিকসসদের বিরুদ্ধে আমি সর্বশেষ যে অভিযান পরিচালনা করলাম তাতে আমার অবদানের কথা বেমালুম বাদ দিয়ে গেল সে। সত্যি কথা বলতে একবারের জন্যও আমার নামটা তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনলাম না। কেবল তার পালনকর্তা ফারাও উটেরিক টুরোর কথা বলে গেল সে, সেইসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যে সাহসী সৈন্যরা যুদ্ধ করেছে, যাদের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল ফারাওয়ের নিজের; তাদের কথা। ফারাও উটেরিক টুরোর নেতৃত্বের গুণাবলি, সাহস এবং তার জ্ঞান আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কথা বলে চলল সে, যার মাধ্যমে আমাদের মিশরকে এক শতাব্দীব্যাপী দাসত্ব থেকে মুক্ত করা গেছে। সে এটাও বলল যে, উটেরিকের আগে যে পাঁচ ফারাও এসেছেন তারা সবাই একই ফলাফল অর্জনের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। সেই পাঁচ ফারাওয়ের মাঝে, এমনকি উটেরিক টুরোর বাবা টামোসও আছেন। নিজের ভাষণ সে শেষ করল এই বলে যে, এই বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই ফারাও উটেরিক টুরো স্বর্গের দেবতা হোরাস আইসিস, ওসিরিস এবং হাথোরের পাশে স্থান পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেছেন। এবং এ কারণেই মেফিসে হিকসসদের কাছ থেকে ফারাও উটেরিক যে সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন তার একটি প্রধান অংশ ব্যবহার করা হবে একটি মন্দির তৈরির কাজে। ফারাও উটেরিকের সাধারণ মানুষ থেকে স্বর্গীয় এবং অমর দেবতায় পরিণত হওয়ার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে তৈরি করা হবে মন্দিরটি।
মেনাক্ট যখন এই ভাষণের মাধ্যমে জনতার মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে ব্যস্ত, আমার নাবিকরা তখন আমাদের সাথে নিয়ে আসা সম্পদ সব জাহাজ থেকে নামিয়ে ঘাটের ওপর তূপ করে রাখতে শুরু করেছে। সে সময় সত্যিই এক। অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। উপস্থিত জনতার সবার মনোযোগ মেনাক্টের লম্বা চওড়া বক্তৃতা থেকে সরে গিয়ে স্থির হলো স্থূপীকৃত সম্পদের ওপর।
অবশেষে নীরব হলো মেনাক্ট, শেষ হলো তার বক্তৃতা। নির্দেশ পেয়ে সামনে এগিয়ে এলো গাড়িগুলো। ক্রীতদাসরা ঘর্মাক্ত দেহে সম্পদভর্তি সিন্দুকগুলো তুলতে লাগল সেগুলোতে। সব ভোলা হয়ে গেলে চাবুক বাতাসে ছুঁড়ে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল গাড়িগুলোর চালকরা। সাথে সাথে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রহরীরা তাদের ঘিরে তৈরি করল নিরাপত্তা বেষ্টনী। লুক্সর শহরের প্রধান দরজার দিকে চলতে শুরু করল সম্পদবাহী গাড়ির বহর।
এই সব কিছু দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম আমি। ভেবেছিলাম এই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হবে আমার, ফারাওয়ের হাতে সম্পদের ভার তুলে দেওয়ার সম্মানটুকু আমি ছাড়া আর কেউ পাবে না। এই উপহার পাওয়ার পর নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞ বোধ করবে ফারাও, তার সম্পূর্ণ স্বীকৃতি এবং শুভেচ্ছা পাব আমি। এখন যা ঘটছে তার প্রতিবাদ জানাতে চাইলাম আমি, গাড়িবহরের নেতৃত্বের অবস্থান যে একান্তই আমার অধিকার সেটা বোঝানোর জন্য এগিয়ে গেলাম মেনাক্টের দিকে।