ঠিক বলেছ! তাকে আশ্বস্ত করলাম আমি। মহান উটেরিক, মিশরের ফারাও। এই গুপ্তধনের আসল মালিক ছিল তার পূর্বপুরুষেরা।
আমার কথাগুলো নীরবে কিছুক্ষণ ভেবে দেখল ওরা। তারপর বেশ সতর্কতার সাথে হুরোতাস প্রশ্ন করল, তার মানে তুমি উটেরিক টুরোর রাজত্বেই থেকে যাবে বলে ঠিক করেছ?
সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললাম আমি। আমি একজন মিশরীয়, অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। এই দেশে আমার প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। আর কোথায় যাব আমি?
তাকে তুমি বিশ্বাস করো?
কাকে?
কাকে আবার, আস্ত গাড়ল উটেরিককে? বেশ জোর দিয়ে বলল হুরোতাস।
সে আমার ফারাও। অবশ্যই আমি তাকে বিশ্বাস করি।
লুক্সর যুদ্ধের সময় কোথায় ছিল তোমার ফারাও? কড়া গলায় প্রশ্ন করল হুরোতাস। কোথায় ছিল সে যখন মেফিসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর আমরা আক্রমণ চালালাম?
উটেরিক আসলে ঠিক যোদ্ধা প্রকৃতির নয়। তার মনটা খুবই নরম, ফারাওয়ের পক্ষে অজুহাত তৈরি করার চেষ্টা করলাম আমি। তবে তার বাবা টামোস ছিলেন একজন দক্ষ এবং সাহসী যোদ্ধা।
এখানে ছেলেকে নিয়ে কথা হচ্ছে, বাবাকে নিয়ে নয়, আমাকে মনে করিয়ে দিল হুরোতাস।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করলাম আমি। অবশেষে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি আমি ধরে নিতে পারি যে আমি যখন ফারাও উটেরিক টুয়োর কাছে এই বিজয়ের খবর নিয়ে যাব তখন তুমি আমার সঙ্গী হচ্ছ না?
মাথা নাড়ল হুরোতাস। আমার মন পড়ে রয়েছে ল্যাসিডিমনে আমার রানি আর কন্যার কাছে। লুক্সরে আমার যে কাজ ছিল তা শেষ হয়েছে। তা ছাড়া ওই শহরে এখনো এমন মানুষ আছে যারা আমাকে সেই আগের জারাস বলে চিনে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তোমার ফারাও উটেরিক টুরোর সাথে আমার মাত্র একবার দেখা হয়েছে, এবং সেই সাক্ষাতে তাকে আমার পছন্দ করার মতো কোনো মানুষ বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয় নিজের আস্তানায় ফিরে গেলেই ভালো করব আমি। সেখানে অন্তত পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আরেকজনের হাতে নয়। এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপড় মারল সে। তুমি আমার পুরনো বন্ধু। আমরা সবাই যেমন জানি তুমি যদি সত্যিই ততটা জ্ঞানী হয়ে থাকো তাহলে এই বিশাল সম্পদে তোমার অংশটুকু আমার কাছে দিয়ে দেওয়াই উচিত হবে তোমার। তাহলে তোমার কাছ থেকে খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই সম্পদ আমি নিরাপদে রাখতে পারব এবং সম্পদ হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় থাকবে না তোমার। যদিও আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে আমার কথা শুনলে শীঘ্রই আমাকে ধন্যবাদ জানাবে তুমি।
আমি ভেবে দেখব কথাটা, কিছুটা অনিচ্ছুক গলায় জবাব দিলাম আমি।
হুরোতাস আর হুই আরো দশ দিন রইল মেফিসে। এই সময়ের মাঝে মেসি থেকে পাওয়া সকল ক্রীতদাস আর অন্যান্য সম্পদের ভার জাহাজে তুলল তারা। তার মাঝে হিকসস গুপ্তধন থেকে পাওয়া আমার নিজের অংশও রইল। অনেক চিন্তাভাবনার পর সেগুলো হুরোতাসের জিম্মায় রাখতে সম্মত হয়েছি আমি। সব শেষে নিজেদের রথ আর ঘোড়াগুলো জাহাজে তুলল তারা। নীলনদের পশ্চিম তীরে পাথরের তৈরি জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে একে অপরকে বিদায় জানালাম আমরা।
হুই এবং রাজকুমারী বেকাথার চার ছেলে আমাদের সাথে ছিল মেফিসে। প্রত্যেকে এখন একটি করে রথ বাহিনীর প্রধান। যদিও ওদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তেমনভাবে পাইনি আমি; তবে মনে হয়েছে ওরা ওদের বাবা এবং মায়ের সব লক্ষণই পেয়েছে। আর তার অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকেই সুদর্শন যুবক, সাহসী এবং দক্ষ রথচালক। সবার বড় জনের নাম হচ্ছে হুইসন, কারণটা তো নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে। বাকি তিনজন হলো সস্টেটাস, পালমিস এবং লিও। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে নামগুলো বর্বর গ্রিক ভাষা থেকে নেওয়া। কিন্তু যেভাবে ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের সম্মানিত ও সাহসী স্বজন বলে সম্বোধন করল তাতে ওদের প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল। ল্যাসিডিমনে পৌঁছেই নিজেদের মা আর খালার কাছে আমার ভালোবাসার কথা পৌঁছে দেবে বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিল ওরা।
নীলনদের অববাহিকা থেকে ল্যাসিডিমন দ্বীপ পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য একটি অনুমতিপত্র লিখে আমার হাতে দিল হুরোতাস। তার সাথে আরো দিল মেসি থেকে পাওয়া গুপ্তধনে আমার অংশের দলিল। সেগুলো আমার হাতে খুঁজে দিয়ে বলল, এবার আশা করি প্রথম সুযোগেই আমাদের সাথে দেখা করতে যাবে তুমি, আর কোনো অজুহাত দেখাবে না। কথাগুলো বলার সময় ওর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো, দ্বিতীয়বার আমাদের বিদায়ের মুহূর্তে কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে।
ওদিকে আমি নিজেও আমার দুই প্রিয় রাজকুমারী তেহুতি এবং বেকাথার জন্য আলাদা আলাদা চিঠি লিখলাম দুটো প্যাপিরাসে। বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই ওগুলো তাদের হাতে তুলে দেবে হুই আর হুরোতাস। এখানে আমার মুখের কথাই হয়তো যথেষ্ট হতো; কিন্তু এই দুই গুণ্ডা কথাগুলো হুবহু ওদের স্ত্রীদের মুখস্থ শোনাতে পারবে কি না তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চিঠিতে এত সুন্দর কাব্যিক অলংকার দিয়ে লিখেছিলাম আমি যে এত বছর পরেও সেগুলো নিঃশব্দে আবৃত্তি করতে গেলে পানি চলে আসে আমার চোখে।
এবার সবাই জাহাজে উঠল, ঘাট থেকে ঠেলে সরিয়ে নেওয়া হলো জাহাজ। দাঁড়িদের দাঁড় টানার সুবিধার জন্য তালে তালে বাজতে শুরু করল ঢাক। লম্বা দাঁড়গুলো ছন্দবদ্ধ তালে সাগরের বুকে উঠতে আর নামতে শুরু করল। জাহাজের সারি দেখে মনে হতে লাগল ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কোনো বিশালাকায় সাগর দানব। নীলনদের স্রোত অনুকূলে থাকায় বেশ দ্রুতই প্রথম মোড়টা ঘুরে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। পরবর্তী গন্তব্য নদীর অববাহিকা যেখানে বিশাল ভূমধ্যসাগরে নেমে গেছে নীলনদ।