মনে মনে আশা করলাম, এই চিৎকারের শব্দ শুনে আমাদের কাছে এগিয়ে আসবে সেরেনা। আরো জোরে মোচড় দিলাম আমি। কাজ হলো আমার চেষ্টায়, আগের চাইতেও তীক্ষ্ণ কান ফাটানো চিৎকার বেরিয়ে এলো উটেরিকের গলা দিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল চিৎকার, ঢিল পড়ল তার শরীর এবং হাত-পাগুলোতে। তখনো তার হাত ধরে রেখেছি আমি, ওই অবস্থাতেই হুড়মুড় করে আমার ওপর পড়ে গেল সে। তার নিচ থেকে বের হয়ে এলাম আমি, উল্টে দিলাম শরীরটা। দেখলাম পিঠের ঠিক মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে সেই নীল তলোয়ারটার হাতল। চুনি পাথরটা জ্বলছে জ্বলজ্বল করে। উটেরিকের মেরুদণ্ড দুই খণ্ড হয়ে গেছে তলোয়ারের আঘাতে।
ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল সেরেনা। এটা উটেরিক ছিল তো? প্রশ্ন করল ও। ওহ আর্টেমিস! আমরা যাকে খুন করলাম সেই যেন সঠিক ব্যক্তি হয়!
সেটা নিশ্চিত হওয়ার কেবল একটাই উপায় আছে, ওকে বললাম আমি, তারপর হাত বাড়িয়ে দিলাম লাশের চেহারা ঢেকে রাখা কাপড়টার দিকে। এক টানে সরিয়ে ফেললাম সেটা। তারপর চিত করে শুইয়ে দিলাম শরীরটাকে। নীরবে তাকিয়ে রইলাম মৃত লোকটার চেহারার দিকে।
দুই ভাই তারা, সেই হিসেবে রামেসিসের মতোই সুদর্শন এবং অভিজাত হওয়া উচিত ছিল উটেরিকের চেহারা। কিন্তু না, ধূর্ততা আর শঠতার ছাপ স্পষ্ট তার চেহারায়।
ভাইয়ের মতো দয়ালু এবং চিন্তাশীলও হতে পারত তার অবয়ব। কিন্তু তার বদলে তার চেহারায় আঁকা রয়েছে উন্মত্ত, নিষ্ঠুর এক মানুষের ছাপ।
উঠে দাঁড়িয়ে উটেরিকের পিঠে একটা পা দিয়ে চেপে ধরলাম আমি, তারপর আরেক হাতে তার শরীর থেক টেনে বের করলাম তলোয়ারের উজ্জ্বল নীলচে ফলাটা। তারপর সেটাকে উল্টো করে ধরে হাতলটা বাড়িয়ে দিলাম সেরেনার দিকে। কাজটা শেষ করবে না? প্রশ্ন করলাম আমি। কিন্তু মাথা নাড়ল সেরেনা। ফিসফিস করে জবাব দিল :
গত কয়েক দিনে অনেক রক্তপাত দেখেছি আমি, প্রিয় টাইটা। আর দেখতে চাই না। আমার হয়ে তুমিই শেষ করো এটা।
ঝুঁকে এসে উটেরিকের মাথার পেছন দিকের কোঁকড়া চুলগুলো মুঠো করে চেপে ধরলাম আমি। তারপর ধুলোর মধ্য থেকে তুলে আনলাম তার মাথাটা, যাতে গলায় তলোয়ারের ফলা চালানোর সময় তা নিচের পাথুরে মাটিতে লেগে নষ্ট না হয়ে যায়। এক হাতে মাথাটা উঁচু করে ধরে রাখলাম আমি, আরেক হাতে তলোয়ারের ফলাটা আলতো করে ঘাড়ের ওপর ছুঁইয়ে মেপে নিলাম দূরত্ব। তলোয়ারটা এত ধারালো যে ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই সরু একটা লাল দাগ ফুটে উঠল ঘাড়ের চামড়ায়, লক্ষ্যস্থির করতে সুবিধা করে দিল আমার। তারপর তলোয়ারের ফলা মাথার ওপর তুলে ধরে নামিয়ে আনলাম এক কোপে। সাথে সাথে ঘাড় থেকে আলাদা হয়ে গেল উটেরিকের মাথা। নিজের রক্ত থেকে তৈরি হওয়া পুকুরের মধ্যে থপ করে একটা ভোতা আওয়াজ তুলে পড়ে গেল তার শরীর। এবার কাটা মাথাটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরলাম আমি। বললাম, যতগুলো মানুষকে খুন করেছিস তুই, তাদের প্রত্যেকের বদলে যেন হাজারবার মরতে হয় তোকে!
তারপর হাঁটু গেড়ে বসে মাথাটাকে জড়িয়ে নিলাম একটু আগে লাশের মুখ থেকে খুলে আনা কাপড়টা দিয়ে। এটা দিয়েই নিজের চেহারা ঢেকে রেখেছিল উটেরিক।
কী করবে ওটা দিয়ে? আমার কাজ দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল সেরেনা। পুড়িয়ে ফেলবে, নাকি মাটিচাপা দেবে?
আনন্দের বাগানের প্রধান দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হবে এটাকে, ডুগের খুলিটার পাশে, জবাব দিলাম আমি। হেসে উঠল সেরেনা।
সত্যিই, প্রিয় টাইটা! তোমার কোনো তুলনা হয় না!
*
তখনই ঘাদাকার কুষ্ঠরোগীদের গ্রাম ছেড়ে বিদায় নিতে চাইল না সেরেনা। গ্রামের বাসিন্দাদের সবার নাম লিখে নিল ও, প্রতিশ্রুতি দিল যে জীবনের বাকি দিনগুলো সেরেনার পক্ষ থেকে খাবার এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ পাবে তারা। সবার কষ্ট লাঘব করার জন্য যতটা সম্ভব চেষ্টা করল ও, যখন কেউ মারা গেল তখন তার জন্য শোক প্রকাশ করল। স্বাভাবিকভাবেই আমাকেও থেকে যাওয়ার জন্য বাধ্য করল সেরেনা।
শেষ পর্যন্ত যখন এখান থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের পরিচিত পৃথিবীতে সেরেনাকে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলাম তখন দশ দিন পেরিয়ে গেছে। রোগীদের মাঝে তখনো যারা হাঁটতে সক্ষম তারা গ্রাম পার হয়েও আরো বেশ কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে গেল আমাদের। নিজেদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগেও বারবার সেরেনাকে চিৎকার করে ধন্যবাদ জানাল তারা, কেউ কেউ এমনকি কেঁদেও ফেলল।
শেষ পর্যন্ত লুক্সরে ফিরে এলাম আমরা। ফিরে আসার পর সেরেনা প্রথমেই যে কাজটা করল সেটা হচ্ছে ঘাদাকার উদ্দেশ্যে নিয়মিতভাবে খাবার এবং ওষুধপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করা। যদিও এখন ওর হাতে অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা। মিশরের রাজা এবং রানি হিসেবে রামেসিস এবং ওর অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় এখন সমাগত। তা সত্ত্বেও সবার আগে কুষ্ঠরোগীদের সেবার ব্যাপারটাই নিশ্চিত করল ও।
অভিষেক উৎসব উপলক্ষে রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতিকে লুক্সরে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাল রামেসিস আর সেরেনা। স্বাভাবিকভাবেই রাজি হয়ে গেল তারা। জেনারেল হুই এবং তার স্ত্রীও হুরোতাস আর তেহুতির উদাহরণ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তার ওপরে বোয়েশিয়ার রাজা বের আর্গোলিদের নেতৃত্বে বাকি চৌদ্দজন মিত্র রাজাও সিদ্ধান্ত নিল যে এই পরিস্থিতিতে তাদের এত দ্রুত ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই; বিশেষ করে এই মুহূর্তে যখন ভয়ানক শীতের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে তাদের রাজ্যে।