সাথে সাথে হঠাৎ উত্তেজিত চিৎকার উঠল ওদের মাঝ থেকে। হাসি কান্না ব্যথা ক্ষুধা আর হতাশার এক অদ্ভুত মিশ্রণ সেই চিৎকারে। অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল সবাই, তারপর কেউ লাফিয়ে লাফিয়ে কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেল গ্রামের প্রবেশপথের দিকে। সেরেনার কাছ থেকে খাবারের কথা শোনার পর আর তর সইছে না কারো।
এগোতে গিয়ে পড়ে গেল কেউ কেউ, আমি আর সেরেনা গিয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম তাদের। আমাদের ঘোড়ায় তুলে নিলাম তাদের, তারপর সামনে এগিয়ে গেলাম। ওদিকে রোগীদের প্রথম দলটা ততক্ষণে খাবারের সন্ধান পেয়ে গেছে। অবিশ্বাস আর আনন্দ মেশানো চিৎকার বেরিয়ে এলো তাদের গলা দিয়ে।
হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে বস্তাগুলো টেনে ছিঁড়তে শুরু করল তারা। যাদের হাতে আঙুলগুলো ইতোমধ্যে কুষ্ঠের আক্রমণে খসে পড়েছে তারা দাঁত ব্যবহার করে খুলে ফেলল আবরণ, তারপর রক্তাক্ত ফাটা ঠোঁটের মাঝ দিয়ে মুখে পুরতে শুরু করল খাবার।
গ্রামের ভেতরে কুঁড়েগুলোর ভেতর যারা বসে ছিল তাদের কানেও গেল সেই উল্লসিত চিৎকার। মধুর প্রতি আকৃষ্ট মৌমাছির মতো দলে দলে দৌড়ে এলো তারা। যারা একেবারেই দুর্বল এবং যাদের দেহে রোগের আক্রমণ প্রায় শেষ পর্যায় পৌঁছে গেছে; তারা অন্যদের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু তার পরেও হাঁটু আর কনুইয়ে ভর দিয়ে টেনে নিতে লাগল নিজেদের কয়েক টুকরো রুটি অন্তত জোগাড় করতে চায়। যাদের গায়ে এখনো শক্তি আছে তারা এক টুকরো শুকনো মাংসের জন্য কুকুরের মতো মারামারি করতে লাগল নিজেদের মাঝে।
এই হট্টগোলের মাঝে এমনকি আমি আর সেরেনাও আলাদা হয়ে পড়লাম। খুব বেশি দূরে নয় অবশ্য, তবে যেটুকু দূরত্ব তৈরি হলো তা ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই দেবতাদের ভাষা তেনমাস ব্যবহার করে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠল সেরেনা, সাবধান! কাছেই আছে সে।
কীভাবে বুঝলে? একই ভাষায় জানতে চাইলাম আমি।
আমি ওর গন্ধ পাচ্ছি।
সেরেনার ঘ্রাণশক্তিকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না, অনেক আগেই জেনে গেছি আমি। যেকোনো শিকারি কুকুরের চাইতেও তীক্ষ্ণ ওর নাক।
দ্রুত এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। সাথে সাথেই চারপাশের ভিড়ের মাঝে কমপক্ষে চারটি চেহারা ঢাকা মানুষকে চোখে পড়ল আমার। সাথে করে দুটো ছুরি এনেছি আমি। কোমরের ডান পাশে খাপের ভেতরে রয়েছে শিকারের বড় ছুরিটা। দুই দিকেই ধার এটার, প্রায় এক কিউবিট লম্বা। ইচ্ছে করলেই ডান হাতে ওটা বের করে আনতে পারব। তারপর আমার পিঠ বরাবর কাপড়ের নিচে রয়েছে আরেকটা ছুরি। যদিও এটার দৈর্ঘ আধ কিউবিটের বেশি হবে না, তবে দুই হাত দিয়েই ওটাকে বের করে আনার সুবিধা রয়েছে আমার। তবে এই মুহূর্তে আমার চারপাশে অনেকগুলো মানুষ, সবাই অসুস্থ এবং দুর্গন্ধযুক্ত এবং তাদের কারণে বেশ বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেছি আমি। আমার বাম কাঁধের পেছন দিকটা অরক্ষিত এখন, ওই জায়গায় কোনো আঘাত এলে চাইলেও ঠেকাতে পারব না। তাই নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোনোমতে শরীর মুচড়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, যাতে পিঠের দিকটায় কারো আক্রমণ না আসে।
আবারও তেনমাসে সেরেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম আমি, আমার পেছনে বাম দিকে কোনো অসুবিধা নেই তো?
নিচু হও! হঠাৎ করেই চিৎকার করে বলে উঠল ও। ওর গলায় এমন কিছু একটা ছিল, যা আমি আগে কখনো শুনিনি। সাথে সাথেই পায়ের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলাম, হাটু ভাজ করে পড়ে গেলাম নিচে। অনেকগুলো পা দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে দিয়ে। কোনোটা নগ্ন, তাতে কুষ্ঠরোগের নানারকম ক্ষত আর পুঁজভর্তি ঘায়ে ভর্তি। কোনোটা আবার শুকনো রক্ত আর পুঁজমাখা কাপড় দিয়ে মোড়ানো। সবাই চেষ্টা করছে সামনের জনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমার মাথার ঠিক ওপরে একটা ছুরি ধরা হাত পাগলের মতো কোপ মারছে এদিক-ওদিক, এক মুহূর্ত আগেও ঠিক ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। লুক্সরের অ্যাম্ফিথিয়েটারে যখন তীরের আঘাতে মারা পড়েছিল উটেরিক এবং অলৌকিকভাবে বেঁচে উঠেছিল আবার, তখন তার হাতের যে বর্ণনা আমি সেরেনার কাছে শুনেছিলাম, তার সাথে এই হাতের চেহারা সম্পূর্ণ মিলে যায়। মসৃণ, মেয়েলি একটা হাত, ঝকঝকে পরিষ্কার। কিন্তু হাতের মালিক ব্যক্তিটি যেন সাক্ষাৎ শয়তান।
মাটিতে পড়ে গেছি আমি, এমন একটা অবস্থা যে সঙ্গে থাকা দুটো অস্ত্রের কোনোটাই বের করতে পারছি না। আমার মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে গেল উটেরিকের ছুরি ধরা হাত, ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি করতে থাকা কোনো একজনের নগ্ন ক্ষতবিক্ষত ঊরু চিরে দিল। সাথে সাথে রক্ত বেরিয়ে এলো সেখান থেকে, ব্যথায় চিৎকার করে উঠল লোকটা। সেই চিৎকারে যেন আরো পাগল হয়ে উঠল উটেরিক। প্রচণ্ড আক্রোশের সাথে এদিক-ওদিক ছুরি চালাতে লাগল সে। আরো একটা মহিলা আহত হলো তার ছুরির খোঁচায়।
মাথার ওপর বাম হাতটা বাড়িয়ে ধরলাম আমি, খপ করে চেপে ধরলাম উটেরিকের কবজি। যখনই বুঝলাম যে আমার হাতটা ঠিক জায়গামতোই ধরতে পেরেছে তখন ডান হাত ব্যবহার করে চেপে ধরলাম তার ছুরির হাতল ধরে রাখা আঙুলগুলো। এই অবস্থা থেকে ছুটতে পারার কোনো উপায় নেই তার। এবার কবজিটা ধরে হাতটা উল্টো দিকে মোচড় দিলাম, যতক্ষণ না ভেতরের রগগুলো ছিঁড়তে শুরু করল মট মট করে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল উটেরিক।