এই জায়গায় এসে রথ থামাল রথের চালকরা, তারপর বয়ে আনা জিনিসগুলো দ্রুত নামিয়ে রাখতে শুরু করল এক পাশে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভয়ে কাঁপছে সবাই। শুকনো খাদ্যশস্য আর মাংসের বস্তাগুলো পথের এক পাশে তাড়াহুড়ো করে সাজিয়ে রাখল তারা। কাজটা করার সময় বারবার ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগল সৈকতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কুঁড়েঘরগুলোর দিকে। শেষ বস্তাটা নামিয়ে রাখার সাথে সাথেই রথে উঠে বসল তারা, ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে ফিরতি পথে ছুটতে শুরু করল। সঙ্গীরা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, একই সাথে লুক্সর ফিরে যাবে তারা।
এখন এখানে আমি আর সেরেনা বাদে আর কেউ নেই। ঘোড়া নিয়ে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে প্রবেশ করলাম আমরা। কুঁড়েগুলোর দরজা দিয়ে কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল আমাদের। যদিও তাদের দেখার কোনো উপায় নেই, কারণ সবাই নিজেদের চেহারা সম্পূর্ণ ঢেকে রেখেছে কাপড় দিয়ে। কুঁড়েগুলোর দরজায় কোনো পাল্লা নেই, মাটির দেয়ালে নেই কোনো জানালা। সৈকতের সামনে গজিয়ে ওঠা নারিকেল গাছের জটলার দিকে এগিয়ে চললাম আমরা, কেউ আমাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলল না বা এগিয়ে এলো না আমাদের দিকে। বাতাসে যেন ভারী হয়ে ঝুলে আছে নীরবতা আর হতাশার ভার।
ঘোড়া নিয়ে আমার কাছাকাছি সরে এলো সেরেনা। একদম পাশাপাশি আসার পর ফিসফিস করে বলল, উটেরিককে এখানে কীভাবে খুঁজে পাব আমরা? সে যদি এখানকার অন্য বাসিন্দাদের মতো মুখোশ আর কাপড় দিয়ে চেহারা ঢেকে রাখে তাহলে তাকে কীভাবে চিনব? কথাগুলো এত আস্তে বলল ও, শোনার জন্য কান পাততে হলো আমাকে।
ওকে খুঁজে বের করা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে না, জবাব দিলাম আমি। পৃথিবীতে যে দুজন মানুষকে উটেরিক সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে তাদের নাম হচ্ছে সেরেনা এবং টাইটা। আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে। নিজেদের এদের সামনে প্রকাশ করা। তারপর উটেরিকই আমাদের খুঁজে নেবে। তবে সতর্ক থেকো। যখন সে আসবে তখন কিন্তু মোটেই সময় পাব না। আমরা, কেউ সাবধানও করে দেবে না আমাদের।
নারিকেল গাছের জটলার নিচে সেই মানুষগুলোকেই বসে থাকতে দেখা গেল, যাদের ঢালের ওপর থেকে দেখেছিলাম আমি। মনে হলো যেন একটুও নড়েনি তারা, বা জীবনের কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি তাদের মধ্যে। কেবল আমরা যখন জটলার মধ্য দিয়ে এগোতে শুরু করলাম, দুই-একটা মাথা আমাদের লক্ষ্য করে একটু ঘুরল মাত্র। যেখানে ওদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে মনে হলো সেই জায়গাটায় এসে থামলাম আমরা। দশ থেকে বারোজনের মতো রোগী বসে আছে এখানে।
তোমাদের নেতা কে? গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। এখানকার পরিবেশটাই এমন, না চাইলেও ভারী হয়ে ওঠে গলা। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া গেল না, বরং মনে হলো যেন আগের চাইতে আরো ভারী হয়েছে নীরবতার ভার।
তারপর হঠাৎ করেই ভয়ংকর এক হাসির শব্দ চিরে দিল সেই নীরবতা। মাথা ঢেকে বসে থাকা লোকগুলোর মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, সেটা এখনো ঠিক হয়নি। ওই অবস্থানের জন্য কবরস্থানের দেবতা আনুবিসের সাথে এখনো লড়াই করছে মৃত্যুর দেবী হেকাটি। জবাবটা কার মুখ থেকে বের হলো বুঝতে পারলাম না; কিন্তু আরো কয়েকজন হেসে উঠল কথাগুলো শুনে।
তোমাদের কাছে কোনো খাবার আছে? আবার চেষ্টা করলাম আমি।
তোমার খিদে পেয়েছে? তাহলে গত সপ্তাহে যে নারিকেলের শাসগুলো খেয়েছিলাম সেগুলো একবার খাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারো। এই কয়দিনে কিছুটা হলেও হজম হয়ে যাওয়ার কথা! মুখোশপরা মানুষগুলোর মধ্য থেকে আরেকজন বলে উঠল। এবার আরো জোরালো হলো হাসির শব্দ, তাতে ব্যঙ্গের পরিমাণও যেন বাড়ল আরো। তাদের হাসির তোড় থামার জন্য অপেক্ষা করলাম আমি আর সেরেনা।
তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি আমরা, গলা চড়িয়ে বলে উঠল সেরেনা, ঘোড়ার রেকাবে পা রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে। সেদ্ধ শূকরের মাংস আর শুকনো মাছ। সেইসাথে বাজরা আর জোয়ারের রুটি। অনেক আছে, পেট ভরে খেতে পারবে সবাই!
সঙ্গে সঙ্গে গভীর অটুট নীরবতা নেমে এলো আবার। মানুষগুলোর মাঝ থেকে একজন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত ভঙ্গ হলো না সেই নীরবতা। এক টানে মাথার ওপর থেকে আবরণ সরিয়ে ফেলল সে, যাতে তার চেহারা ঢাকা ছিল। ভয়ংকর, বীভৎস এক দৃশ্য। কুষ্ঠের কামড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে তার নাক আর কান, সেইসাথে ওপরের ঠোঁট। ফলে কঙ্কালের খুলির মতো চিরস্থায়ী, ভয়ানক এক হাসি ফুটে আছে তার মুখে। একটা চোখের পাতা অদৃশ্য হয়ে গেছে, আরেকটা বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। যে চোখটা খোলা সেটা টকটকে লাল। সাগরের লোনা বাতাসে ভর করে মাংস পচা দুর্গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। বমি উঠে আসতে চাইল আমার, অনেক কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। শয়তানের দল, চেঁচিয়ে উঠল মহিলা। খোলা চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। আমাদের কষ্ট নিয়ে তামাশা করতে এসেছিস? জানিস যে আমাদের কাছে কোনো খাবার নেই, তাও কেন লোভ দেখাচ্ছিস শুধু শুধু? দয়ামায়া নেই তোদের মনে? কী ক্ষতি করেছি আমরা তোদের যে আমাদের সাথে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছিস?
তার দিকে ঘুরে তাকাল সেরেনা। করুণায় ভরে উঠেছে ওর কণ্ঠ। বলল, দেবী আর্টেমিসের নামে শপথ করে বলছি, তোমাদের সবার জন্য যথেষ্ট খাবার নিয়ে এসেছি আমি। তোমাদের গ্রামের ঠিক বাইরেই পাঁচটা গাড়ি ভর্তি খাবার অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। যদি তোমরা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে থাকো, খাবারের কাছে যাওয়ার শক্তি না থাকে তাহলে আমি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসব ওগুলো। নিজ হাতে খাইয়ে দেব তোমাদের…