ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিলাম আমরা, সাথে নিয়ে আসা থলে থেকে পানি খাওয়ালাম। তারপর উপত্যকার উঁচু ঢাল বেয়ে সৈকতের দিকে নামতে শুরু করলাম। তবে অর্ধেক পথও এগোইনি, এই সময় হঠাৎ দূরে দুই অশ্বারোহীকে দেখতে পেলাম আমরা, ঢাল বেয়ে আমাদের দিকেই উঠে আসছে। আমাদের কাছ থেকে মাইলখানেক দূরে থাকতেই তাদের চিনতে পারলাম আমি আর সেরেনা। দেবত্বের অধিকারী হওয়ার কারণে এত দূর থেকেই ওদের চিনতে পারল সেরেনা, আর আমি পারলাম আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তির কারণে।
দুজনই আমাদের ঘোড়ার পেটে খোঁচা দিয়ে জোর কদমে এগোনোর নির্দেশ দিলাম। কাছাকাছি আসতে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, এই যে, বাতুর! কী খবর, নাসলা?
আমি বুঝে গেছি প্রভু, আপনার সাথে তর্ক করে কোনো লাভ নেই, আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল নাসলা। তার ছোট ভাইও তার কথায় সম্মতি জানাল এবার কখনো ভুল হয় না আপনার, এতে কি একটু হলেও একঘেয়েমিতে ভোগেন না আপনি?
তার মানে কোনো দুর্গের অস্তিত্ব নেই এখানে? আরো একবার নিজের অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হওয়ায় উল্লসিত বোধ করলাম আমি।
তা নেই, জবাব দিল বাতুর। তবে তার চাইতে শত গুণে খারাপ একটা জিনিস আছে। জায়গাটার বেশি কাছাকাছি যাওয়ার সাহস পাইনি আমরা, আধ লিগ দূরত্ব থেকেই ফিরে এসেছি আবার। আমার মনে হয় আপনারাও একই কাজ করবেন। এমনকি উটেরিকের লোকরাও তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। এই পথ দিয়েই যাচ্ছিল তারা, এবং আমাদের সাথে তাদের দেখা হয়েছে। ওরা ভেবেছিল আমরা দুজন এখনো উটেরিকের পক্ষে রয়েছি, তাই কোনো কিছু লুকোয়নি আমাদের কাছে। ফারাও রামেসিসের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য লুক্সর ফিরে যাচ্ছে ওরা।
আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না, বাতুর! কড়া গলায় বললাম আমি। কোনো দুর্গ যদি নাই থাকে তাহলে উটেরিক কোথায় আশ্রয় নিয়েছে? বলো?
কুষ্ঠরোগীদের মাঝে আশ্রয় নিয়েছে সে, প্রভু। ঘোড়ার পিঠের ওপর ঘুরে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে নির্দেশ করল বাতুর। ওই যে, ওই দিকে। ছোট্ট একটা গ্রামের নাম হচ্ছে ঘাদাকা। একাই আছে উটেরিক, তার সঙ্গী বলতে কেবল কয়েক শ কুষ্ঠরোগী। উটেরিকের সঙ্গীরা কেউ তার সাথে থাকতে রাজি হয়নি। সবাই ধরে নিয়েছে যে পাগল হয়ে গেছে সে। অবশ্য আমি ওদের মতামতে রাজি হতে পারিনি। আমার ধারণা, জন্মের পর থেকেই পাগল হয়ে ছিল উটেরিক। নতুন করে আর কি পাগল হবে? কথাগুলো বলার সময় হাসির কোনো চিহ্ন ফুটল না বাতুরের চেহারায়।
মনে হলো যেন বজ্রপাত হলো আমার মাথায়। এমন ঘটনা খুব সম্ভব প্রথমবার ঘটল আমার জীবনে। আর একটা কথাও না বলে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেলাম। একটা পাথর খুঁজে বের করে বসলাম তার ওপরে, তারপর গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইলাম ঘাদাকা নামের দুরের ওই ছোট্ট গ্রামটার দিকে। গ্রাম বলতে কিছু এক কামরার মাটির কুঁড়েঘরের সমষ্টি কেবল, খুব বেশি হলে পঞ্চাশ কি ষাটটা হবে। এক টুকরো অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকতের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো। কুঁড়েগুলোর কাছে কিছু মানুষের আকৃতিকেও চিনতে পারলাম আমি, এক দল নারিকেল গাছের নিচে বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। পুরুষ আর মহিলা আলাদা করে চেনার উপায় নেই, সবাই নিজেদের মাথা এবং মুখ কাপড় দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে। কোনো নড়াচড়া নেই কারো মাঝে, যেন মারা গেছে সবাই।
ভয় পেয়েছি আমি। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারছি মৃত্যুভয় জেগেছে আমার মধ্যে। আমার সামনে ওই এক টুকরো সৈকতের মাঝে নীরব নিঃশব্দ এক মৃত্যুর মহড়া চলছে, সেই মৃত্যুর ভয় পাচ্ছি আমি। আমি জানি যে দেবত্বের চিহ্ন আছে আমার মধ্যে, অন্য সব সাধারণ মানুষের চাইতে আমি আলাদা। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি না যে কেবল ওই জ্ঞানটুকুর ওপর ভরসা করে ওই কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে আমার ঢোকা ঠিক হবে কি না।
হঠাৎ করে মৃদু সুগন্ধ ভেসে এলো আমার নাকে। না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আমার পাশে এসে বসেছে সেরেনা। আমার হাতের ওপর ওর কোমল স্পর্শ পেলাম আমি।
তোমার আর আমার তো কোনো ভয় নেই, মৃদু স্বরে বলল সেরেনা। ঘুরে বসে ওর চোখে চোখ রাখলাম আমি। সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ও জানে। আমাদের মাঝে দেবত্বের চিহ্ন সম্পর্কে ওর জানা আছে, যদিও ওকে এটা না জানানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি আমি। সবই জানা আছে ওর, এবং হয়তো সে কারণেই আরো একবার বিশ্বাস ফিরে পেলাম আমি।
আর কিছুর দরকার হলো না। সেরেনার হাত ধরে ওকে দাঁড় করলাম আমি। প্রশ্ন করলাম উটেরিকের শাস্তির ভার দেবতাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারছ না তুমি? মাথা নাড়ল ও।
এতে যে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না, তা তুমি জানো। উটেরিকের কাছে, সেইসাথে নিজের কাছে শপথ করেছি আমি। ঠিক আছে।
ওই গ্রামে যাব আমরা দুজন। তোমার শপথকে সত্যি প্রমাণিত করে আসব।
ঘোড়াগুলো যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে এলাম আমরা, তারপর সেগুলোতে চড়ে চলে এলাম আমাদের রথগুলোর কাছে। বাকিদের সাথে এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বাতুর আর নাসা।
*
পরদিন ভোরে সেরেনা আর আমি পাঁচটা রথে ভর্তি করে নিলাম নানা রকম খাবার এবং জীবনধারণের অন্যান্য উপকরণ। তারপর সেগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রসৈকতের ওপর গড়ে ওঠা ছোট্ট বসতিটার কাছে। এখানে এক জোড়া ফটক রয়েছে যদিও, তবে বহু আগেই ভেঙে গেছে তা। এখন স্রেফ একটা কজার ওপর ঝুলছে সেই দরজার পাল্লা। তার এক পাশে রয়েছে একটা নির্দেশনামা। তাতে লেখা রয়েছে একটা সাবধানবাণী: আর সামনে এগিও না, যদি তুমি দেব-দেবীদের এবং নিজের জীবনকে ভালোবেসে থাকো! এখান থেকে যত সামনে এগোবে দুঃখ আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাবে না তুমি।