*
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের পেছনে রেখে যাওয়া ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। তারপর গলা চড়িয়ে ওয়েনেগকে ডেকে বললাম, উটেরিককে অনুসরণ করতে হবে। এক শ ঘোড়সওয়ার জোগাড় করতে কতক্ষণ লাগবে তোমার?
সাথে সাথে কোনো জবাব দিল না ওয়েনেগ। তার বদলে শোয়া অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর প্রাচীরের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে। চিন্তিত হয়ে আছে তার চেহারা। সত্যিই আপনি উটেরিকের পেছনে ধাওয়া করতে চাইছেন?
হ্যাঁ, সত্যিই চাইছি। নিজের কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতার ছোঁয়া টের পেলাম আমি। বোকার মতো প্রশ্ন শুনতে আমার একেবারেই ভালো লাগে না।
কিন্তু সরাসরি শুশুকান এলাকার দিকে যাচ্ছে উটেরিক। মাত্র এক শ জন লোক নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করা ঠিক হবে না। এই কাজ করতে হলে কমপক্ষে একটা সেনাবাহিনী দরকার হবে আপনার।
শুশুকান? এবার গলা কিছুটা নামিয়ে আনলাম আমি। এর আগে কখনো এই নাম শুনিনি আমি। কীসের বা কার কথা বলছ তুমি?
ক্ষমা চাইছি প্রভু টাইটা। আরো পরিষ্কার করে বলার দরকার ছিল আমার। কয়েক সপ্তাহ আগে, এমনকি আমি নিজেও ওদের সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ওরা হচ্ছে নির্বাসিত চোর-ডাকাত এবং অপরাধীদের একটা দল। সভ্যতা এবং সমাজের বাইরে বসবাস করে ওরা, কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধরে না। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিল সে, আমাকে শান্ত করতে চাইছে। আমার মনে হয় তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের একবার আলোচনায় বসা উচিত।
উটেরিক যদি সত্যিই ওই এলাকার দিকে গিয়ে থাকে এবং তোমার কথার সাথে শুশুকানদের চরিত্রের যদি কোনো মিল থাকে তাহলে বলতে হবে যে ভালোই হয়েছে। আমাদের বদলে শুশুকানরাই তার ব্যবস্থা করতে পারবে। তাতে অনেক ঝামেলা থেকেও বেঁচে যাব আমরা, বলে মৃদু হাসলাম আমি। কিন্তু আবারও মাথা নাড়ল ওয়েনেগ।
আমি শুনেছি, উটেরিক নিজেই হচ্ছে ওই শুশুকানদের নেতা এবং ওদের ওই জাতির প্রতিষ্ঠাতা। লোকে যে উটেরিককে বহুরূপী বলে, তা এমনিতে বলে না।
এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল সেরেনা। এবার মুখ খুলল ও। একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। উটেরিক কেন ওদের সাথে মিত্ৰতা করতে চাইবে? মিশরের ফারাও হিসেবে নিশ্চয়ই সবার ওপর সর্বময় অধিকার এবং কর্তৃত্ব আছে তার?
মাথা নাড়লাম আমি। সেই কর্তৃত্ব কেবল সভ্য নাগরিকদের ওপরে। কিন্তু এমনকি একজন ফারাওয়ের পক্ষেও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। উটেরিক যদি একই সাথে ফারাও এবং শুশুকানদের নেতা হিসেবে শাসন চালাতে পারে তাহলে বুঝতে হবে যে ভালো এবং খারাপ উভয় দিকই তার নিয়ন্ত্রণে আছে।
কী চালাক শয়তানটা! বলে উঠল সেরেনা। কিন্তু একই সাথে শিকারের গন্ধ পাওয়া সিংহীর মতো ঝলসে উঠল ওর চোখ জোড়া। কিন্তু এখন তার জন্য ভালো অংশে ফেরার পথ বন্ধ করে দিয়েছ তুমি, টাইটা। লুক্সরসহ এই মিশরের অন্য যেকোনো শহরে ঢোকার রাস্তা এখন তার জন্য বন্ধ। এখন শুধু শুশুকানদের সাথে ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় নিতে পারবে না সে, এবং ওটাই তার উপযুক্ত স্থান।
এই অপরাধীদের আস্তানা এবং এলাকা সম্পর্কে যা যা জানার আছে সব জেনে নিতে হবে আমাদের, সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। ওদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য গুপ্তচর পাঠাব আমরা। কে ওখানে শাসন করে, নিয়ম-কানুন কে বা কারা তৈরি করে ইত্যাদি ইত্যাদি- অবশ্য উটেরিক ওখানে যে পরিবেশ তৈরি করেছে তাতে আইন-কানুনের বালাই থাকলেই বরং অবাক হব আমি।
ইতোমধ্যে খোঁজ নিতে শুরু করেছি আমি, আমাকে আশ্বস্ত করল ওয়েনেগ। সুযোগ পাইনি, না হলে আরো আগেই আপনাকে জানাতাম। আপনি এখানে এসে পৌঁছানোর পরপরই উটেরিক এসে হাজির হলো, তাই আর বলা হয়নি। শুশুকানকদের নেতা হিসেবে যে লোকটার নাম শোনা যায় তার আসল নাম কেউ জানে না। তবে নিজেকে পাগলা কুকুর হিসেবে পরিচয় দেয় সে।
একেবারে সঠিক নাম, সন্দেহ নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম আমি।
আমি জানতে পেরেছি লোকটা নাকি আসলেই অত্যন্ত শয়তান। সোজা কথায় শুশুকানদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার চাইতে উপযুক্ত লোক কেউ নেই।
এমনও হতে পারে, এই পাগলা কুকুর হচ্ছে উটেরিকেরই অনেকগুলো ছদ্মনামের একটা, বললাম আমি। তারপর প্রশ্ন করলাম, উটেরিকের হাতে কতজন শুশুকান আছে সে সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছ?
তা ঠিক জানা যায়নি। তবে কেউ কেউ বলে লাখখানেকের কম হবে না।
কথাটা শুনে ঢোক গিলোম আমি। উটেরিকের হাতে যদি এর অর্ধেক লোকও থেকে থাকে তাহলে ধরতে হবে যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীটা রয়েছে তার দখলে। আর কী কী জানতে পেরেছ? ওয়েনেগকে প্রশ্ন করলাম এবার।
লোকমুখে জানা গেছে, লোহিত সাগরের তীরে ঘাদাকা নামক জায়গাতে বিশাল এক দুর্গ গড়ে তুলেছে সে। সেখান থেকেই নাকি পুরো পৃথিবী দখলের অভিযান পরিচালনা করবে উটেরিক।
ওয়েনেগের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করলাম আমি। পুব দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাতাসে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে উটেরিকের রথ বাহিনীর রেখে যাওয়া ধুলোর মেঘ। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে এলাম ওয়েনেগের কাছে।
আমাকে যে কথাগুলো তুমি বললে তার সবই তো শোনা কথা, তাকে বললাম আমি। কাঁধ ঝাঁকাল ওয়েনেগ, অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে দাঁড়াল।