তবে শহরের প্রধান দরজায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল ইতোমধ্যে খুলে রাখা হয়েছে সেটা। মনে হলো সব কিছু ঠিকঠাকই আছে। এমনকি প্রহরীদের মাঝ থেকে তিন-চারজনকে আমি চিনতেও পারলাম। সবাই ওয়েনেগের লোক তারা। সাথে সাথেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, উটেরিক এবং তার সঙ্গীরা এখনো উত্তর থেকে এখানে এসে পৌঁছায়নি। তবে এটা বুঝতে পারছি যে, আর খুব বেশি দূরেও নেই তারা।
আমাকে দেখে দারুণ খুশি হয়ে উঠল শহরের প্রহরীরা। সেরেনাকে যখন বললাম ছদ্মবেশ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখাতে তখন ওকেও সাথে সাথেই চিনতে পারল তারা। সাথে সাথেই বিনয়ে গলে পড়তে শুরু করল সবাই, পারলে সেরেনার পা ধরে বসে থাকে আর কি। শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে সংবিত ফিরিয়ে আনার জন্য কয়েকজনকে কষে লাথি কষলাম আমি, তারপর কাজ হলো। এবার তাদের নির্দেশ দিলাম সোনালি প্রাসাদে অবস্থানরত ওয়েনেগের কাছে নিয়ে যেতে আমাদের। ফারাওইনের এই হঠাৎ আগমনে ওয়েনেগও দারুণ খুশি হয়ে উঠল। তবে বেশিক্ষণ তাকে খুশি হয়ে থাকার সুযোগ দিলাম না আমি, কড়া গলায় মনে করিয়ে দিলাম যে উটেরিক এবং তার রথ বাহিনী আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে নেই।
চার ঘণ্টা পর যখন উটেরিকের রথ বাহিনী শেষ পর্যন্ত লুক্সরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, দেখল যে বন্ধ করে রাখা হয়েছে দরজা। শহরের প্রাচীরের ওপর দেখা যাচ্ছে না কাউকে। পুরো শহরকে যেন চাদরের মতো ঘিরে রেখেছে অখণ্ড নীরবতা। খুব সাবধানে প্রধান দরজা থেকে দূরে রথ নিয়ে দাঁড়াল তারা, যেখানে তীরের পাল্লা পৌঁছবে না। নিঃসন্দেহে আবু নাসকোস থেকে এ পর্যন্ত পূর্ণ গতিতে ঘোড়াগুলোকে ছুটিয়ে এনেছে তারা। রথের সাথে জোড়া ঘোড়াগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনো বেঁচে আছে সেগুলোর শরীর ধূলিমলিন, ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত। আবু নাসকোসের দুর্গ ছেড়ে যখন তারা বের হচ্ছিল তখন তাদের রথের সংখ্যা চল্লিশ বলে শুনেছিলাম আমি। প্রতিটা রথকে টানছিল পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবান পাঁচটা করে ঘোড়া। এখন সেই রথগুলোর সংখ্যা নেমে এসেছে ঊনত্রিশে। বাকি এগারোটা রথ নিশ্চয়ই চাকা হারিয়েছে অথবা শিক ভেঙে অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে সেগুলো পথেই ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা। বাড়তি যে ঘোড়াগুলো জমা হয়েছে সেগুলোকে রথচালকরা নিজেদের সাথে খেদিয়ে এনেছে। এই কয়েক দিনের মাঝেই ওজন হারিয়েছে ঘোড়াগুলো, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তেল চকচকে চামড়ায় এখন ধুলোর পুরু আবরণ। চার-পাঁচটা ঘোড়া খোঁড়াচ্ছে।
শহরের দেয়ালের ভেতর নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওয়েনেগের লোকেরা। বেশির ভাগই রয়েছে শহরের প্রাচীরের ওপর; কিন্তু তাদের মাথা নামিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়েছি আমি, যাতে নিচ থেকে দেখা না যায়। বাকিরা জড়ো হয়েছে শহরের দরজার এ পাশে। বাইরে থেকে তাদের কাউকে দেখার উপায় নেই; কিন্তু সবাই আমার নির্দেশের অপেক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে এই মুহূর্তে।
উটেরিক টুরো নিশ্চয়ই আর যাই হোক প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে বলে আশা করেনি। জেনারেল পানমাসির হাতে শহরটার দায়িত্ব ছেড়ে গিয়েছিল সে। এখন আশা করছিল যে এখানে আসার সাথে সাথে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে বেরিয়ে আসবে পানমাসি। যখন তার কোনো দেখা পাওয়া গেল না, সাথে সাথে সতর্ক হয়ে উঠল সে। সন্দেহের বীজ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এবং ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম, কারণ উটেরিককে খুব ভালো করেই চেনা আছে আমার। বুঝতে পারলাম, দেয়ালের ওপর যারা ছিল তাদের মাথা নিচু করে রাখতে বলে ভুল হয়ে গেছে।
উটেরিককে দেখতে পাচ্ছ? সেরেনাকে প্রশ্ন করলাম আমি। ফটকের ওপর আমার পাশাপাশি শুয়ে আছে সেরেনা। দেয়ালের গায়ে একই ফুটো দিয়ে সামনে চোখ রেখেছি আমরা।
এখনো দেখা যাচ্ছে না, ধুলোর মেঘে ঢেকে আছে সব, জবাব দিল ও। তা ছাড়া এখনো অনেক দূরে রয়েছে ওরা।
বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে উটেরিকের লোকেরা, তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। শহরের দরজার আরো কাছাকাছি এগিয়ে আসতে চাইছে সবাই। ধীরে ধীরে রুদ্ধশ্বাস একটা অবস্থার দিকে মোড় নিচ্ছে পরিস্থিতি।
আমি দেখলাম, দিনের বেলার প্রচণ্ড গরমের কারণে উটেরিকের রথচালকদের বেশির ভাগই তাদের শিরস্ত্রাণ এবং বর্ম খুলে ফেলেছে। চোখের ওপর হাত রেখে রোদের তীব্রতা থেকে দৃষ্টিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম আমি, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলাম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দলটার দিকে। দেখছি কাউকে চেনা যায় কি না। হঠাৎ করে দলের মধ্য থেকে একজন মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা তুলে ধরল দুই হাতে, সম্ভবত ঘুরিয়ে বসাতে চাইছে। একই মুহূর্তে তার ঘোড়াটা চক্কর খেল একবার। ফলে সূর্যের আলো এসে সরাসরি আঘাত করল তার চেহারায়। সেরেনার বাহু খামচে ধরলাম আমি। ওই যে সে!
এভাবে না বললেও চলত, ব্যথা লাগছে আমার, প্রতিবাদ জানাল সেরেনা। আমার গায়ে যে প্রচণ্ড শক্তি সেটা মাঝে মাঝে আমি নিজেই ভুলে যাই। তবে ওটা যে উটেরিক এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। ভুল দেখেনি আমার চোখ, এবং এটাও বুঝতে পারছি যে শহর প্রাচীরের ওপর কোনো লোকজন না দেখে সন্দেহ জেগে উঠেছে তার মনে। আরো একবার পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। ধনুকে তীর জুড়েই উঠে দাঁড়ালাম আমি। জানি যে দূরত্বটা অনেক বেশি হয়ে যায়, এবং উটেরিকও এক জায়গায় স্থির হয়ে নেই। ঘোড়ার মুখ ঘোরাচ্ছে সে, এবং একই সাথে পেটে পা দিয়ে খোঁচা দিয়ে দৌড়ানোর জন্য তাগাদা দিচ্ছে। তার পরও তীর ছুড়লাম আমি। আমার চোখের সামনেই আকাশে উঠল তীরটা, তারপর নামতে শুরু করল। মনে হলো যেন কোনোভাবেই ভুল হবে না, উটেরিককে খুন করতে না পারলেও অন্তত আহত করবে আমার তীর। নিঃশব্দে উল্লাস করে উঠলাম আমি। কিন্তু তার পরই হঠাৎ এক ঝলক বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগল আমার মুখে। দেখলাম বাতাসের মুখে পড়ে বদলে গেল তীরটার গতিপথ, উটেরিকের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল সেটা। এত কাছ দিয়ে তীর ছুটে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল সে, ঘোড়ার গলার সাথে প্রায় শুইয়ে ফেলল নিজেকে। বাকি ঘোড়সওয়াররা তাড়াতাড়ি এসে উটেরিককে ঘিরে ফেলল চারপাশ থেকে, তারপর দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে পুব দিকে সরে যেতে শুরু করল তারা। ওদিকেই রয়েছে বিশাল এক উপত্যকা, এবং লোহিত সাগর।