মাথা ঝাঁকাল হুরোতাস। অনুমতি দেওয়া হলো তোমাকে।
রাজপরিবারের কাউকে সঙ্গী হিসেবে দরকার হবে আমার, যাতে আমার অভিযান আলাদা গুরুত্ব এবং সম্মান পায়। তাই এই কাজে সঙ্গী হিসেবে ফারাও রামেসিসই আমার প্রথম পছন্দ। কিন্তু এই মুহূর্তে এখানেই তার প্রয়োজন বেশি বলে মনে হচ্ছে আমার।
তাহলে হয় রাজা হুরোতাস, অথবা রানি রেহুতির মাঝ থেকে কাউকে যেতে হবে টাইটার সাথে, আমাকে সমর্থন জানিয়ে বলল রামেসিস। কিন্তু এবার আপত্তি জানাল অন্য কয়েকটা কণ্ঠস্বর।
তুমি আমাদের আপন মেয়ের জামাই, এবং তোমার মাথায় মুকুট পরানোর অনুষ্ঠান পালন করা হবে এখন। এই অবস্থায় অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে টাইটার সাথে যেতে পারি না আমরা, প্রতিবাদ জানাল হুরোতাস। তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে চাপ দিল তেহুতি, স্বামী এবং পরিবারের সিদ্ধান্তের সাথে নিজের একাত্মতা ঘোষণা করল যেন।
এতক্ষণ ধরে কেবল সেরেনাই চুপ করে ছিল। কিন্তু এবার উঠে দাঁড়াল ও, আমার পাশে এসে দাঁড়াল। চেহারায় এমন একটা বিষণ্ণ ভাব ফুটে আছে, যা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য আর প্রাণোচ্ছল স্বভাবের সাথে একেবারেই যায় না। ফলে সাথে সাথে নীরবতা নেমে এলো পুরো কক্ষের মাঝে। সেরেনা কী বলে শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই।
আমি যাব টাইটার সাথে, দৃঢ় গুলায় ঘোষণা করল ও।
না! আমি নিষেধ করছি তোমাকে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল হুরোতাস।
প্রিয় বাবা, যে কাজ আমার অবশ্য কর্তব্য তা করতে কেন বাধা দিচ্ছ। আমাকে? মৃদু গলায় প্রশ্ন করল সেরেনা।
কারণ তুমি একজন মেয়েমানুষ। বোঝা গেল কথাগুলো হুরোতাসের মাথায় আসার সাথে সাথেই বলে ফেলেছে সে এবং খুব একটা চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পায়নি।
হ্যাঁ, আমি সেই মেয়েমানুষ, যে ল্যাকোনিয়ান শূকরকে হত্যা করেছে। আমি সেই মেয়ে, যে কুখ্যাত ডুগের মাথা ধুলোয় লুটিয়েছে। বলতে বলতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল সেরেনা। আমি সেই মেয়ে, যে জেনারেল পানমাসির পেটের ভেতর তীর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি মিশরের রানি, এবং এই দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমি টাইটার সাথে যাচ্ছি বাবা। যদি পারো তো আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই বলে রানি তেহুতির দিকে তাকাল সেরেনা। প্রশ্ন করল মা?
এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে যে অহংকার বোধ করছি আমি তা আর কখনো হয়নি, প্রিয় কন্যা আমার, আবেগে কেঁপে উঠল তেহুতির গলা। এগিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল সে। গর্বের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর পিছিয়ে গেল সে, তারপর কোমর থেকে তোয়ারটা খুলে দুই হাতে ধরে এগিয়ে দিল সেরেনার দিকে। আশা করব, কখনো ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এই তলোয়ার ব্যবহার করবে না তুমি। কিন্তু যদি কখনো ব্যবহার করো, তখন যেন গভীরে আঘাত করতে ভুলো না, প্রিয় কন্যা। নীল তলোয়ারটা সেরেনার কোমরে ঝুলিয়ে দিল সে। বাঁটের সাথে লাগানো বিশাল চুনি পাথরটা যেন ঝলসে উঠল আগুনের মতো।
এবার মাকে রেখে রামেসিসের দিকে ঘুরে গেল সেরেনার দৃষ্টি। স্বামী? একই সুরে প্রশ্ন করল সে। নরম হয়ে এলো রামেসিসের চেহারা।
এখন শুধু নামে নয়, কাজেও নিজেকে রানি হিসেবে প্রমাণ করেছ তুমি, সেরেনাকে উদ্দেশ্য করে বলল ও। আমি যদি তোমার সাথে যেতে না পারি তাহলে যাকে তোমার সঙ্গী হিসেবে দেখতে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব সে হচ্ছে টাইটা। তোমাদের দুজনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা থাকবে সব সময়!
এবার ওর বাবার দিকে তাকাল সেরেনা। তোমার অনুমতি চাইছি আমি, প্রিয় বাবা।
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে দিল হুরোতাস; একই সাথে বিষণ্ণ কিন্তু গর্বের হাসি ফুটেছে চেহারায়। অনুমতি দিলাম তোমাকে, প্রিয় কন্যা আমার।
*
আনন্দের সাথেই আমাদেরকে সৈন্যদের মাঝ থেকে এক শ দক্ষ সৈনিক এবং তাদের জন্য চল্লিশটা রথ আর পর্যাপ্ত ঘোড়া বেছে নেওয়ার সুযোগ দিল হুরোতাস। সেইসাথে বাতুর ও নাসলা এবং আরো ছয়জন যোদ্ধাকে সঙ্গে নিলাম আমি, এরা সবাই উটেরিককে চিনত এবং আরো একবার দেখলে সাথে সাথে চিনতে পারবে। তারপর সবচেয়ে দ্রুতগতিতে কীভাবে লুক্সর পৌঁছানো যায় তাই নিয়ে আলোচনা করতে বসলাম সেরেনার সাথে। বছরের এই সময়ে নদীর এই অংশে স্রোতের গতি প্রায় একজন মানুষের দ্রুত পায়ে হাঁটার গতির সমান। যার অর্থ হচ্ছে, বিপরীত দিকে চলমান যেকোনো নৌকার গতিকে অর্ধেকে নামিয়ে আনবে এই স্রোত। কিন্তু দিনে ও রাতে যেকোনো সময়েই চলতে পারবে নৌকা। অন্যদিকে অশ্বারোহীরা কেবল নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পথ চলতে পারে, তারপর বিশ্রাম নিতেই হয় তাদের। তাই সেরেনা এবং আমি আমাদের সৈন্য ও ঘোড়াগুলোকে পাঁচটা বড় বড় নৌকায় তুলে নিলাম। আবু নাসকোসের সামনেই নদীর বুকে অপেক্ষা করছিল সেগুলো। দাঁড় বাওয়ার জন্য লোকের অভাব হলো না, এবং নির্দিষ্ট দলে ভাগ করে পালা করে দাঁড়া টানানো হলো তাদের দিয়ে। স্রোতের বুক চিরে নদীর উজানে এগিয়ে চললাম আমরা, লক্ষ্য লুক্সর শহর।
দিনে এবং রাতে উভয় সময়েই উত্তর থেকে বইতে লাগল হাওয়া। সেই হাওয়া লেগে ফুলে উঠল পাল, স্রোতের বিপরীতে চলা আরো সহজ হয়ে উঠল। তবু মনে হতে লাগল দিন এবং ঘণ্টাগুলো যেন অসহ্য রকমের দীর্ঘ হয়ে উঠেছে আর কাটতেই চাইছে না। শেষ পর্যন্ত একদিন ভোরে নৌকার মাস্তুলের ওপর উঠতেই নদীর তীরে পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আনন্দের বাগানের সুউচ্চ চুড়া চোখে পড়ল আমার। এক ঘণ্টা পর লুক্সর শহরের প্রধান বন্দরে ভিড়ল আমাদের ছোট্ট বহর। ছয়জন লোককে সাথে নিয়ে তীরে নামলাম আমি এবং সেরেনা। সবাই, বিশেষ করে সেরেনা; ছদ্মবেশ পরে নিয়েছে আগেই। আমরা এখনো জানি না যে আমাদের আগেই শহরে পৌঁছে গেছে কি না উটেরিক। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে অনেক রকম বিপদই ঘটতে পারে আমাদের ভাগ্যে। এমনও হতে পারে যে, আবারও শহর দখল করে নিয়েছে সে। যদিও তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।