পাশাপাশি চারটি করে রথ ছুটে চলেছে পথ দিয়ে, এবং এমন দশটা সারি গুনলাম আমি। যার অর্থ হচ্ছে বাতুর আর নাসলা যে কয়টা রথের কথা বলেছিল তার সবই রয়েছে এখানে। শেষ সারিটা যখন পার হয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ সবচেয়ে কাছাকাছি রথের চালক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি সেটা কী করে বুঝলাম সে প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনেই জাগতে পারে। রথগুলোর ওপর সবাই তো শিরস্ত্রাণ আর মুখাবরণ দিয়ে চেহারা ঢেকে রেখেছিল, কেবল চোখের কাছে সরু দুটো ফুটো ছিল সামনে দেখার জন্য। কিন্তু এই বিশেষ ব্যক্তির দৃষ্টিটাকে যেন অনুভব করতে পারলাম আমি। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকাল সে, একই সাথে একটা তীর জুড়ল ধনুকে। তার পরেই হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে দ্বিতীয়বার আমার দিকে ঘুরে গেল তার দৃষ্টি। আমাকে চিনতে পেরেছে সে। আর কোনো সন্দেহ রইল না আমার মনে। আমার প্রতি এত তীব্র ঘৃণা কাজ করছিল ওই দৃষ্টিতে, মনে হলো যেন কেউ এক পাত্র ফুটন্ত গরম পানি ছুঁড়ে দিয়েছে আমার মুখে। সেই মুহূর্তেই নিশ্চিতভাবে বুঝে গেলাম আমি, আর কেউ নয়; বরং আমার চিহ্নিত শক্রই রয়েছে ওই রথের ওপর। মিশরের বর্তমান ঘৃণিত ফারাও, নিজেকে মহান এবং অপরাজেয় বলে দাবি করা উটেরিক টুরো।
এবার অবিচল ভঙ্গিতে ডান হাতে ধরা ধনুকটা ওপরে তুলল সে, এক টানে তীরটা নিয়ে এলো তার মুখাবরণের কাছাকাছি। মুখের কাছটায় যেখানে ছোট্ট ফুটো রয়েছে সেই পর্যন্ত তীরের লেজটা টেনে আনল সে। ওদিকে সৈন্যদের ভিড়ের চাপে দেয়ালের সাথে অসহায়ভাবে আটকে রয়েছি আমি, যেন কেউ পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে। এমনকি মাথাটা নামানোরও সুযোগ নেই আমার। তবে ডান হাতে উটেরিককে ধনুক উঁচু করতে দেখে আমার মনে পড়ল যে সে বাঁহাতি। যার অর্থ হচ্ছে বাম দিকে কিছুটা ঘেঁষে যাবে তার ছোঁড়া তীর। উটেরিকের ডান হাতের আঙুলগুলোর বিশেষ নড়াচড়া চোখে পড়ল আমার, যা দেখে বোঝা যায় যে কখন তীর ছুড়ছে তীরন্দাজ। ঠিক সেই অনুযায়ী মাথা ঘুরিয়ে নিলাম আমি। তীরের গতিপথটা খালি চোখে অনুসরণ করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে, এত দ্রুত উড়ে এলো সেটা। কিন্তু অনুভব করলাম আমার গালে এক ঝলক বাতাসের ঝাঁপটা দিয়ে কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল তীরটা। প্রায় একই সাথে সেটাকে আমার মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের খুঁটির সাথে তীক্ষ্ণ শব্দে ধাক্কা খেতে শুনলাম। সংঘর্ষের ফলে ফেটে কয়েক টুকরো হয়ে গেল তীরটা। প্রায় সাথে সাথেই আমাকে চেপে ধরে রাখা ভিড়ের চাপ কমে গেল হঠাৎ। ধপ করে বসে পড়লাম আমি।
সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালাম না আমি, তবে সেটা উটেরিকের দ্বিতীয় তীরের ভয়ে নয়। কান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করেছে, সেটা থামাতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল আমার। শেষ পর্যন্ত যখন উঠে দাঁড়াতে পারলাম তখন শত্রুদের রথগুলো বের হয়ে গেছে প্রধান ফটক দিয়ে। এই মুহূর্তে নদীর পাশের সমতল জমির ওপর দিয়ে পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে ছুটছে তারা। তাদের পেছনে ধাওয়া করেছে হুরোতাসের কয়েক শ সৈন্য। তবে পদাতিক সৈন্য তারা, এবং খুব দ্রুত তাদের তীরেরও আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে রথগুলো। অনেকে ইতোমধ্যে রথের পিছু নেওয়ার চেষ্টা ছেড়ে দুর্গের দিকে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আগামীকাল সকালের মধ্যেই উটেরিক এবং তার সঙ্গীরা কমপক্ষে বিশ লিগ দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলবে। কিন্তু যাবে কোন দিকে তারা? আমার মনে হলো, উত্তরটা আমি জানি।
*
তাহলে এবার কোথায় যাবে উটেরিক? আবু নাসকোস দুর্গের সম্মেলন কক্ষে বসেছে আলোচনা সভা। সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছে হুরোতাস। উপস্থিতদের মধ্যেই অনেকের দৃষ্টি ঘুরে গেল আমার দিকে। তাই এবার আমার দিকে ও তাকাল সে। বলো, মহামান্য টাইটা। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী?
বাকি সবার মতোই হুরোতাস দারুণ দিলখোলা মেজাজে আছে এখন, যা সাধারণত তার মাঝে খুব কমই দেখা যায়। ঘণ্টাখানেক আগেই দুর্গের কোষাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। তার সামনেই প্রথমবারের মতো খোলা হয়েছে কোষাগারের দরজা। রাজকীয় হিসাবরক্ষক এবং অন্য কেরানিরা এখনো প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সব সম্পদের হিসাব করবে। তার মাঝ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ বণ্টন করা হবে সেই সব সাহসী সৈনিকের মাঝে, যারা মিশরকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করেছে এবং প্রতিদানে কী পাবে তার কথা একবারও ভাবেনি।
উটেরিকের জন্ম হয়েছে লুক্সরে, হুরোতাসের প্রশ্নের জবাবে বললাম আমি। সমস্ত জীবন সেখানেই কাটিয়েছে সে। এই মিশরের বাইরে যায়নি কখনো, এবং কখনো যাবে বলেও আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত, উটেরিক বিশ্বাস করে যে লুক্সর শহর এখনো তার রেখে যাওয়া প্রতিনিধিদের হাতেই রয়েছে। বাচ্চা ছেলে যেমন আগুনে হাত পুড়িয়ে ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায়, একইভাবে উটেরিকও এখন রওনা দেবে লুক্সরের পথে।
অল্প কথায় সব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছ তুমি, টাইটা, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল হুরোতাস। তাহলে এবার বলো, আমাদের হয়ে তাকে ধরে আনতে পারবে তুমি?
আমার প্রথম ইচ্ছা সেটাই, হুয়োতাসকে আশ্বস্ত করলাম আমি। আনুগত্য, সম্মান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে তো আছেই আমার, তা ছাড়া আরো একটা কারণে তার পিছু ধাওয়া করতে চাই আমি। আর সেটা হলো মিশরের ধনসম্পদের অনেক বড় একটা অংশ এখনো অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে উটেরিক। আজ এই দুর্গে আমরা যা উদ্ধার করেছি তা সেই সম্পদের তুলনায় কিছুই নয়। এবং আমি চাই সেই সম্পদকে পুনরুদ্ধার করতে। যদি তোমার অনুমতি থাকে তাহলে এই মুহূর্তে লুক্সরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে চাই আমি।