বন্দিদের দলগুলো নিয়ে আমরা যখন মেসি শহরে পৌঁছলাম, দেখলাম ইতোমধ্যে তাকে ঘিরে অবরোধ বসিয়েছে হুরোতাসের সৈন্যরা। রথ জিনিসটা যতই কাজের হোক, অবরোধের মতো ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না। তাই রথচালকদের নামিয়ে শহর প্রাচীরের নিচে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো। ওই পথ দিয়েই শহরে ঢুকব আমরা, খামুদি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বের করে আনব শহরের ভেতর থেকে।
আর সব অবরোধের মতোই এটাও হলো অত্যন্ত ক্লান্তিকর সময়সাপেক্ষ এক অভিযান। প্রায় ছয় মাস ধরে মেফিসের বাইরে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান নিতে বাধ্য হলো আমাদের সেনাবাহিনী। তবে ক্রমাগত সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ফলে একদিন শহরের পুরো পুব অংশের প্রাচীর ধসে পড়ল, গুরুগম্ভীর গর্জনের সাথে সাথে ধুলোর মেঘ উড়ল আকাশে। বহু দূর থেকে দেখা গেল সেই ধুলো। ধসে পড়া অংশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল আমাদের লোকেরা।
আরো অনেক দিন লাগল শহরকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করতে, কারণ শহরটা নদীর দুই তীরেই বিস্তৃত। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিজয়ী বাহিনী খামুদির আস্তানা খুঁজে বের করতে সক্ষম হলো। নিজের প্রাসাদের নিচে এক গুপ্তঘরে পরিবারকে নিয়ে লুকিয়ে বসে থরথর করে কাঁপছিল খামুদি। সৌভাগ্যক্রমে আমরা আবিষ্কার করলাম, সোনা আর রুপার এক বিশাল সম্পদের ভাণ্ডারের ওপর বসে আছে তারা। তার সাথে আরো রয়েছে দামি গহনাভর্তি অসংখ্য বড় বড় সিন্দুক। মিশরীয় জনগণের কাছ থেকে প্রায় এক শতাব্দী সময় নিয়ে এই বিশাল সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছে খামুদি আর তার বাপ-দাদারা। এবার খামুদি আর তার সঙ্গের সবাইকে নীলনদের তীরে বন্দরের ওপর নিয়ে এলো হুরোতাসের সৈন্যরা। এখানে গান আর হাসিঠাট্টার শব্দের সাথে সাথে তাদের এক এক করে পানিতে ডুবিয়ে মারা হলো। সবার আগে মারা হলো পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে।
পরিবারের মাঝে বয়স সবচেয়ে কম ছিল দুই যমজ শিশুর, বয়স হবে দুই কি তিন বছর। অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, হিকসস উপজাতির অন্যদের মতো নয় এদের চেহারা, বরং বেশ সুন্দরই বলতে হবে। নীলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হলো তাদের, পানির নিচে চুবিয়ে ধরে রাখা হলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল খামুদি। এটার জন্যও আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কেন যেন আমার ধারণা ছিল অসভ্য জন্তু-জানোয়ারদের মতোই হিকসসদের মাঝে ভালোবাসা বা কষ্টের কোনো চিহ্ন থাকে না।
খামুদিকে রেখে দেওয়া হয়েছিল সবার শেষে মারার জন্য। যখন তার পালা এলো, পরিবারের অন্যদের চাইতে একটু বেশি গুরুত্বের সাথে পৃথিবী ছাড়ার ব্যবস্থা করা হলো তার জন্য। প্রথমেই কয়লার আগুনে পুড়িয়ে টকটকে লাল করে তোলা ছুরি দিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় তুলে ফেলা হলো খামুদির চামড়া। তারপর চারটে ঘোড়ার সাথে বাঁধা হলো তার চার হাত-পা, ঘোড়া দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো অঙ্গগুলো। উপস্থিত দর্শকদের সবাই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। বোঝা গেল হুরোতাসের সৈন্যদের রসবোধ একটু অতিমাত্রায় চড়া।
এই ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল তখন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। এমনিতে এই সব ব্যাপারে আমি থাকতে না পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু আমার অনুপস্থিতিকে দুর্বলতার পরিচয় হিসেবে ধরে নিতে পারত আমার লোকেরা। মাঝে মাঝে মানুষের সশরীরে উপস্থিতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, শুধু তাদের সুনাম তখন আর যথেষ্ট থাকে না।
.
হুরোতাস, হুই এবং আমি যখন মেসি প্রাসাদে ফিরে এলাম তখন আমরা সবাই ক্লান্ত। তবে খামুদির প্রাসাদের নিচে গুপ্তঘরে রাখা ধনসম্পদের পরিমাপ এবং তালিকা করার কাজে হাত দিতেই খুব দ্রুত স্বাভাবিক চাঙ্গা ভাব আর হালকা মেজাজ ফিরে এলো আমাদের মাঝে। মাঝে মাঝে একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়। জীবনের সব কিছু, সব আশা যদি হারিয়ে যায়, কেবল স্বর্ণ একাই সেই সব কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে।
হুরোতাসের লোকদের মাঝ থেকে সবচেয়ে বিশ্বাসী পঞ্চাশজন লোক আমাদের সাহায্য করল, তবু সব সম্পদের তালিকা গুছিয়ে আনতে কয়েক দিন সময় লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত যখন মূল্যবান ধাতু আর রঙিন পাথরের বিশাল স্কুপের দিকে আমরা আমাদের মশালগুলো তাক করলাম মনে হলো যেন উজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে যাবে আমাদের চোখ। দারুণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমরা।
তামিয়াতের দুর্গে যে ক্রিটীয় গুপ্তধন আমরা দখল করেছিলাম তার কথা মনে আছে তোমার? মৃদু স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল হুরোতাস।
যখন তুমি সবেমাত্র সেনাবাহিনীর এক তরুণ ক্যাপ্টেন এবং যখন তোমার নাম ছিল জারাস? সেই ঘটনার কথা কখনো ভুলব না আমি। আমার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীতেও এই পরিমাণে সোনা এবং রুপা আছে কি না সন্দেহ।
অথচ আমাদের সামনে এখন যা রয়েছে, ওই গুপ্তধন এর দশ ভাগের এক ভাগের সমানও হবে না, বলল হুরোতাস।
তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না, বললাম আমি।
হুরোতাস আর হুই দুজনেই অবাক হয়ে চাইল আমার দিকে। কেন টাইটা?
কারণ এই সম্পদকে আমাদের অন্তত চার ভাগে ভাগ করতে হবে, বুঝিয়ে বললাম আমি। তার পরেও যখন দুজনের চেহারা থেকে বিভ্রান্ত ভাব কাটল না তখন আরো ব্যাখ্যা করে বললাম: তুমি আর হুই, আমি এবং উটেরিক টুরো। ওই আস্ত গাড়ল উটেরিকের কথা বলছ তুমি? হুরোতাসের চেহারা দেখে মনে হলো কেউ বাড়ি মেরেছে ওর মাথায়।