এবার ঝুঁকে এসে তার শিরস্ত্রাণের মুখাবরণটা ওপরে তুলে দিলাম আমি। আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার কাজটা এত সহজ হবে না। বহু রাতে উটেরিকের চেহারা আমার দুঃস্বপ্নে হানা দিয়েছে। এটাও বুঝতে পারছি যে সেই দুঃস্বপ্নের অবসান হয়নি এখনো, আরো দুর্ভোগ বাকি রয়েছে আমার সামনে। কারণ আমার সামনে যে পড়ে রয়েছে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক আগন্তুক। শুধু হাত ছাড়া আর কোথাও উটেরিকের সাথে মিল নেই তার। আরো একবার আমাদের ধোকা দিয়েছে উটেরিক। মাথা নাড়লাম আমি, নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা বুঝতে পেরে কুঁচকে উঠল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনলাম চারদিক থেকে ভেসে আসা নানা ধরনের শব্দ। মরণপণ যুদ্ধে মেতে আছে সবাই: যুদ্ধের চিৎকার, আহতের আর্তনাদ, শিরস্ত্রাণ এবং বর্মের সাথে ধারালো অস্ত্রের বাড়ি খাওয়ার শব্দ, সেইসাথে আরো নানা রকম আওয়াজ- সব মিলিয়ে যেন নরক গুলজার শুরু হয়ে গেছে এখানে।
*
তারপর হঠাৎ খুলে গেল কার্নিশে প্রবেশের দরজা, অনেকগুলো ভারী জুতো পরা পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম আমি। দলবেঁধে ওপরে উঠে এসেছে আমার লোকেরা, এখন আমার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে তারা। সবার মুখে উল্লাসের চিৎকার।
দারুণ, প্রভু টাইটা। শয়তানটাকে মারতে পেরেছেন তাহলে। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে উঠল নাসলা।
হ্যাঁ। উটেরিকের আরো একজন নকল ছিল এই লোক, তার ভুল শুধরে দিলাম আমি। কিন্তু শুধু হাহোর আর ট্যানাসই জানেন এর আসল পরিচয় কী। তবু এর বর্মটা নিয়ে যাব আমরা। দেখে মনে হচ্ছে আসল জিনিস, নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে। তারপর নিচে নেমে সত্যিকারের উটেরিককে খুঁজতে বের হব।
আগন্তুকের অর্ধনগ্ন লাশটা কার্নিশেই ফেলে রেখে ভেতরে চলে এলাম আমরা। সবাইকে নিয়ে এবার এগিয়ে চললাম যুদ্ধের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মাঝে যোগ দিতে।
অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে, কারণ এই পরিস্থিতিতে শত্রু এবং মিত্র আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। একই পোশাক রয়েছে সবার পরনে, একই ধাঁচে কথা বলছি, একই ভাষা ব্যবহার করে। তার ওপর দুর্গের ভেতরে সরু পথগুলোতে আলো নেই বললেই চলে, এবং একই রকম অন্ধকার বিরাজ করছে ভেতরের প্রাঙ্গণ এবং হলঘরগুলোতে। এই অন্ধকারের মধ্যে দূর থেকে মানুষের মুখ চিনতে পারা প্রায় অসম্ভব। অগত্যা সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষই পরস্পরের দিকে অস্ত্র হাতে তেড়ে যাওয়ার আগে নিজেদের নেতার নাম চিৎকার করে বলে উঠতে বাধ্য হচ্ছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে আক্রমণ করবে নাকি একে-অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরবে।
তবে দুর্গের প্রধান ফটক এখন পুরোপুরিভাবে হুরোতাসের সৈন্যদের জিম্মায়। খণ্ড খণ্ড লড়াইয়ের মাঝ দিয়ে পথ করে নিয়ে সৈন্যদের নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, ফটকের কাছাকাছি চলে এলাম। এখানে রাজা হুরোতাসকে পাওয়া গেলাম, সাথে রয়েছে রামেসিস এবং সেরেনা। এরাই দখল করেছে ফটকের কর্তৃত্ব। দুটো দরজারই টানা সেতু নামিয়ে দিয়েছে তারা, তারপর সেগুলো ওঠা-নামা করানোর ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে; যাতে শত্রুরা আবার সেগুলো ওপরে উঠিয়ে দিতে না পারে। এখন সেই পথ দিয়ে দলে দলে ভেতরে ঢুকছে হুরোতাসের সৈন্যরা। যদিও উটেরিকের সৈন্যদের সঠিক সংখ্যা আমাদের জানা নেই, তবে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের সংখ্যার কাছে ওদের হার মানতেই হবে। হুরোতাস! চিৎকারের কাছে হার মানতে শুরু করেছে উটেরিক! চিৎকারের তীব্রতা। অবশ্য এর আরেকটা অর্থ হচ্ছে, উটেরিকের দলের অনেকেই এখন পক্ষ বদল করতে শুরু করেছে। আমি বুঝতে পারছি আবু নাসকোস দুর্গের বিজয় অবশেষে ধরা দিতে শুরু করেছে। আমাদের হাতে। এবার আমার চিন্তা সরে গেল লুক্সরের দিকে। ওয়েনেগ এবং তার সঙ্গীদের পক্ষে ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। হঠাৎ করেই একটা পরিবর্তন চলে এলো যুদ্ধের শব্দে। বিজয়ের উল্লাস হঠাৎ যেন বদলে গেল ভয় এবং বিভ্রান্তিতে ভরা হইচইয়ে। এতক্ষণ সারিবদ্ধভাবে আমাদের সৈন্যরা ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল, হঠাৎ করেই জট পাকিয়ে গেল তাদের সুশৃঙ্খল অগ্রযাত্রায়। এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাতে শুরু করল তারা, ফলে পরিষ্কার হয়ে গেল ফটকের রাস্তা। দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকেই বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে। তার পরই হঠাৎ চলমান রথের চাকার নির্ভুল শব্দ শুনতে পেলাম আমি। ঘোড়ার খুরের শব্দ, সেইসাথে পাথরে বাঁধাই করা পথের ওপর রথের চাকার ধাতব আবরণের ঘর্ষণ; এই শব্দ চিনতে কখনো ভুল হবে না আমার। তবে এর মাঝে যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করে তুলল সেটা হচ্ছে শব্দটা দুর্গের ফটকের বাইরে নদীর দিক থেকে আসছে না, বরং ভেতরেই যেন ওই শব্দের উৎপত্তি। কেবল তখনই আমার মনে পড়ল, বাতুর আর নাসলা আমাকে জানিয়েছিল যে উটেরিক তার রথ বাহিনীর প্রায় অর্ধেকের মতো রথ এবং সেগুলো চালানোর মতো ঘোড়া রেখে দিয়েছে এখানে, যাতে হুরোতাস এবং তার মিত্র রাজাদের হাত থেকে পালাতে পারে। বাকি রথ এবং ঘোড়াগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে নীলনদের অববাহিকায় তার অন্য দুর্গগুলোতে।
এই কথাগুলো মাথায় আসার সাথে সাথেই দেখলাম দুর্গের ভেতর থেকে ফটক লক্ষ্য করে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে একদল রথ। পাগলের মতো ঘোড়াগুলোকে চাবুকপেটা করছে চালকরা। অন্যদিকে রথের ওপর থেকে তীরন্দাজরা একের পর এক তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে আমাদের সৈন্যদের লক্ষ্য করে। রথ বাহিনীর সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেছে সবার মধ্যে। যারা রথের ওপর রয়েছে তাদের সবার শরীর আগাগোড়া ঢাকা রয়েছে বর্মে। মাথায় শিরস্ত্রাণ, মুখে মুখাবরণ। ফলে কারো পরিচয় আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। হুরোতাসের পক্ষের কয়েকজন দুর্ভাগা সৈন্য রথগুলোর সামনে থেকে সঠিক সময়ে সরে যেতে পারল না। সাথে সাথে ঘোড়াগুলোর খুরের তলায় চাপা পড়তে হলো তাদের, রথের চাকার নিচে পড়ে কয়েক মুহূর্তে পরিণত হলো রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে। সৈন্যদের ভিড়ের মাঝে পড়ে গেলাম আমিও, তাদের চাপে বাধ্য হলাম দুর্গের দেয়ালের সাথে সেঁটে থাকতে। কিন্তু তাদের মাথার ওপর দিয়ে সামনে দেখার সুযোগ পেলাম ঠিকই, এবং সেটাকে কাজেও লাগালাম। আমার সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময় রথগুলোকে গুনে নিলাম এক এক করে।