আরো ভালো করে দেখতে পাওয়ার আশায় শরীরের ওপরের অর্ধেক বিপজ্জনক ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে বের করে দিলাম আমি। এবার আরো প্রসারিত হলো আমার দৃষ্টিসীমা। দেখলাম আমার থেকে খুব বেশি হলে দুই তলার মতো নিচে একটা কার্নিশের মতো অংশ রয়েছে। আর তার ওপরে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বর্ম পরা একটা দেহ, মেয়েদের মতো হাত তার। আমার চোখের সামনেই উঠে বসল লোকটা, তারপর মুখ তুলে শিরস্ত্রাণের ফুটো দিয়ে চাইল আমার দিকে।
তোমাকে দেখে ফেলেছি আমি, উটেরিক, বলে উঠলাম আমি। এবার আসছি। তোমাকে ধরতে। কথাটা শুনেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল সে, উদ্ভ্রান্ত চোখে চাইল এদিক-ওদিক। নিঃসন্দেহে পালানোর পথ খুঁজছে। তার নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারলাম জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ার সময় একটা পায়ে ব্যথা পেয়েছে সে। আমিও জানালার ওপর উঠে দাঁড়ালাম এবার, তারপর এক মুহূর্ত বিরতি দিয়েই লাফিয়ে পড়লাম উটেরিককে লক্ষ্য করে। আশা করেছিলাম যে তার ওপরেই পড়ব, তারপর একই ধাক্কায় ফেলে দিয়ে চিরকালের মতো সাঙ্গ করে দেব ওর ভবলীলা। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষিপ্র সে। লাফ দিয়ে এক পাশে সরে গেল সে, আর এক মুহূর্ত আগেও সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে এসে পড়লাম আমি। বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ার কারণে আমার হাতে ধরা তলোয়ারটা ছুটে গেল, পড়ল গিয়ে কার্নিশের ওপরেই; কিন্তু আমার নাগালের ঠিক বাইরে।
চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে সেটাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলাম আমি। কিন্তু একই সাথে চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম খাপ থেকে নিজের তলোয়ারটা বের করে এনেছে উটেরিক, সাক্ষাৎ মৃত্যু সেজে এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। লাফ দিয়ে নিজের তলোয়ারটা মুঠোয় চেপে ধরলাম আমি, তার পরেই গড়িয়ে সরে গেলাম এক পাশে। ওদিকে উটেরিক ততক্ষণে আমার সামনে চলে এসেছে, দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তোয়ার দুই হাতে চেপে ধরে তুলে ধরেছে মাথার ওপর, এখনই নামিয়ে আনবে আমার বুক বরাবর।
ঐতিহ্যগতভাবে মিশরীয়দের বর্মে দুই পায়ের মাঝখানে একটা ছিদ্র থাকে। বর্ম বানানোর সময় কামাররা ইচ্ছে করেই ছিদ্রটা তৈরি করে দেয়, যাতে প্রস্রাব করতে অসুবিধা না হয়। চিত হয়ে শুয়েছিলাম আমি, ফলে উটেরিকের বর্মে ওই ছিদ্রটা খুব সহজেই চোখে পড়ল আমার। সাথে সাথে ব্রোঞ্জের জুতো পরা পা দিয়ে ওই জায়গাটা লক্ষ্য করে লাথি ছুড়লাম, এবং লাথিটা পড়ার সাথে সাথেই বুঝলাম যে জায়গামতোই লেগেছে আমার আঘাত।
সবে তলোয়ারটা আমার বুক লক্ষ্য করে নামিয়ে আনতে শুরু করেছে উটেরিক, এই অবস্থায় আমার লাথি গিয়ে লাগল তার ঊরুসন্ধিতে। সরে যাওয়ার কোনো সুযোগই পেল না সে। হঠাৎ করেই ভয়ানক আঘাত পেয়ে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল তার, তীব্র ব্যথার চোটে দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলল। আমার হৃৎপিণ্ডের দিক থেকে সরে গেল তার তলোয়ারের ফলা। কিন্তু পুরোপুরি বাঁচতে পারলাম না আমি, বাম কাঁধে ঢুকে গেল তলোয়ার। তার পরই টলতে টলতে পিছিয়ে গেল উটেরিক। এক হাতে আহত জায়গা চেপে ধরে আছে আর চিৎকার করছে বাচ্চাদের মতো তীক্ষ্ণ গলায়। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার সময় আমার কাধ থেক তলোয়ারটা বের করে নিয়ে গেছে সে, এবং সেটা এখন নাচাচ্ছে অন্য হাতে।
সোজা হয়ে বসে হাতড়ে হাতড়ে আমার তলোয়ারটা খুঁজে বের করলাম আমি, তারপর সেটা তুলে নিলাম হাতে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলাম উটেরিকের। কার্নিশটা খুব বেশি চওড়া নয় এবং দুর্গের ভেতরে ঢোকার যে দরজা রয়েছে তার এবং উটেরিকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। নিচের দিকে এক নজর দেখে নিল উটেরিক; কিন্তু এখনো অনেক ওপরে রয়েছি আমরা। দেখলাম নিজেকে শক্ত করল সে, তারপর মুখোমুখি হলো আমার। এখনো এক হাতে ঊরুসন্ধি ডলছে, আরেক হাতে বাগিয়ে ধরেছে তলোয়ার। বুঝে গেছে যে আমার সাথে লড়াই করতেই হবে তাকে, এবং এ লড়াই থেকে বেঁচে ফিরবে শুধু একজন।
পতনের ব্যথা খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছি আমি। ডান হাতে ফিরে পেয়েছি তলোয়ারের অভ্যস্ত ওজন, এখন আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এবার ডান পা সামনে রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, একের পর এক আক্রমণ চালাচ্ছি তলোয়ার দিয়ে। উটেরিককে বাধ্য করছি আহত পায়ের ওপর ভর দিতে। একটু আগে ওই পায়েই ব্যথা পেয়েছে সে। শুনতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে দ্রুত হয়ে উঠেছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁপিয়ে উঠছে খুব দ্রুত। কেবল আহত পায়ের যন্ত্রণা নয়, এমনিতেও লড়াই করার মতো শারীরিক শক্তি নেই তার গায়ে। লুক্সরের অ্যাম্ফিথিয়েটারে রাজমন্ত্রী ইরাসের মৃত্যুতে উটেরিক কেমন বিকৃত আনন্দ অনুভব করেছিল সেটা মনে পড়ে গেল আমার। মন্ত্রীর দুই হাত কেটে ফেলেছিল সে, তারপর নিজের রথের পেছনে তার দুই পা বেঁধে চক্কর দিয়েছিল, যতক্ষণ না শক্ত মাটিতে বাড়ি খেয়ে তার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে আসে। একবার মনে হলো ওই একই উপায়ে উটেরিকের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করি। কিন্তু তার পরেই আমার ভেতরের মানবতা বাধা দিল আমাকে।
হঠাৎ করেই আক্রমণের দিক বদলে ফেললাম আমি, ফলে আমার তলোয়ার ধরা হাতের দিকে সরে আসতে বাধ্য হলো উটেরিক। কাজটা করতে গিয়ে হালকা হোঁচট খেল সে এবং সামান্য সময়ের জন্য প্রতিরক্ষার বলয় তুলে রাখতে ভুলে গেল। ঠিক এটাই চেয়েছিলাম আমি। মনে হলো যেন এক ঝলক বিদ্যুতের মতো আঘাত হানল আমার তলোয়ার, এত দ্রুত এগিয়ে গেল যে স্বাভাবিক চোখে ধরাই পড়ে না। তলোয়ারের ফলাটা তার বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম আমি। উটেরিকের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে মেরুদণ্ড কেটে আরো আধ হাতের মতো বেরিয়ে এলো তলোয়ারের ফলা। হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল তার ধপ করে, পড়ে যেতে চাইল শরীরটাও। কিন্তু আমার তলোয়ারের মাথায় তাকে ঝুলিয়ে ধরে রাখলাম আমি। পাগুলো শরীরের নিচে ঝাঁকি খেল কয়েকবার, কার্নিশের মেঝেতে লাথি মারল। তারপর ওই অবস্থাতেই মারা গেল সে। কেবল তার পরেই আমি তলোয়ার নিচু করলাম। আমার পায়ের কাছে দলামোচড়া পাকিয়ে পড়ে রইল উটেরিকের মৃতদেহ।