মাটি থেকে প্রায় আট তলার সমান উঁচু এই দুর্গটা, এবং প্রতিটি তলা কমপক্ষে দশ কিউবিট লম্বা। ফলে প্রায় আশি কিউবিটের মতো ওপরে উঠতে হলো আমাদের। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বেশ কিছু দূর পর পর দেয়ালের গায়ে মশাল জ্বলতে দেখা গেল। কিন্তু তাতে মোটেই আলোকিত হচ্ছিল না চারপাশ। তাই এবার সবাইকে নিজ নিজ মশালে আগুন ধরাতে নির্দেশ দিলাম আমি। এবার যথেষ্ট আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ। এখন ইচ্ছে করলে সরু এবং প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়েও এক দৌড়ে উঠে যেতে পারবে সবাই, হোঁচট খেয়ে পড়ার ভয় নেই আর।
সঙ্গে কী কী অস্ত্র নেওয়া হবে সেটা খুব সাবধানতার সাথে বাছাই করেছি। আমি। শেষ পর্যন্ত কেবল ধারালো অস্ত্রই সাথে রাখব বলে ঠিক করেছি। কেবল তলোয়ার এবং লম্বা ছুরি ছাড়া আর কিছু নেই আমার লোকদের সাথে। তীর-ধনুক জিনিসটা বেশ ঝামেলার এবং বদ্ধ জায়গার ভেতরে ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া যায় না বললেই চলে। খালা তলোয়ার নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম আমরা, যেকোনো সময় শত্রু সৈন্যদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। দুর্গের ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত উঠতেই আমাদের নিচ থেকে হঠাৎ হইচই আর চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। তার পরই আর্তনাদ আর ধাতুর সাথে ধাতুর বাড়ি খাওয়ার শব্দ।
রামেসিসের লোকেরা শত্রুর সামনে পড়েছে! আমার পেছন থেকে বলে উঠল নাসলা।
থেমো না! পাল্টা জবাব দিলাম আমি। দুই শ লোক আছে রামেসিসের সাথে, প্রধান ফটকে পৌঁছে যেতে পারলে আরো সৈন্যের সাহায্য পাবে ও।
সিঁড়ি বেয়ে একটা বাঁক ঘুরলাম আমরা এবং সাথে সাথে শত্রুদের প্রথম দলটার মুখোমুখি হলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নেমে আসছিল তারা। নিশ্চয়ই নিচ তলা থেকে ভেসে আসা লড়াইয়ের শব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠেছে; কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি আমাদের সামনে পড়তে হবে তা ভাবেনি। এখনো কোমরেই রয়েছে তাদের সবার অস্ত্র। প্রথমজনকে স্রেফ তলোয়ার তুলে ধরে রেখেই খুন করলাম আমি। হুড়মুড় করে নেমে আসছিল লোকটা, সোজা এসে পড়ল আমার তলোয়ারের ফলার ওপর। তার কণ্ঠনালি ভেদ করে শিরদাঁড়া কেটে দিয়ে গলার ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল আমার তলোয়ার, উষ্ণ রক্তে ভিজে গেল আমার হাত আর কবজি। তলোয়ারটা সম্পূর্ণ ঢুকে যেতে দিলাম আমি এবং এর ফলে পেছনের লোকটার বুক বরাবর চলে এলো তলোয়ারের ফলা। লোকটা সম্ভবত তাড়াহুড়ো করে বর্ম পরেছে, বুকের কাছে এখনো ফিতে বাঁধা হয়নি। ফলে সেখানটায় উন্মুক্ত রয়ে গেছে তার বুক। আমার তলোয়ার এবার বাঁট পর্যন্ত ঢুকে গেল প্রথম লোকটার গলায়, একই সাথে বিদ্ধ করল দ্বিতীয়জনের বুক। একই সাথে মাটিতে পড়ল তারা, ছটফট করতে লাগল। শেষে প্রথমজনের বুকে পা দিয়ে চেপে ধরে তাকে থামাতে হলো আমার। তলোয়ারটা এদিক-ওদিক মুচড়ে ক্ষতস্থানটা বড় করে নিলাম আমি। এবার সহজেই বেরিয়ে এলো তলোয়ার। ওদিকে নাসলা এবং বাকিরা তখন শত্রুদের বাকিগুলোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। লাফ দিয়ে মৃতদেহগুলো টপকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম আমি। এখন আমরা দুর্গের সর্বোচ্চ তলায় রয়েছি, যেখানে উটেরিকের থাকার কথা।
এবার কোন দিকে? নাসলাকে প্রশ্ন করলাম আমি।
সোজা গিয়ে প্রথম দরজা! থুতনি দিয়ে সামনে ইঙ্গিত করল নাসলা। এক দৌড়ে তার দেখানো দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা, একই সাথে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললাম সেটা। কামরার অন্য পাশে জানালার সামনে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমাদের ভেতরে ঢোকার আওয়াজ পেয়েছে সে, কারণ প্রায় সাথে সাথেই ঘুরে দাঁড়াল। পুরো দস্তুর বর্ম পরে আছে লোকটা। শিরস্ত্রাণের মুখাবরণ সামনে নামানো, সরু ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে চোখ। ডান কোমরে ঝোলানো খাপের মাঝে ভরা রয়েছে তলোয়ার। কেবল হাতগুলো দেখা যাচ্ছে। মসৃণ ফর্সা হাত। কোনো ভাঁজ বা কড়া নেই তাতে, যেন কোনো সুন্দরী তরুণীর হাত। এক নজর দেখেই লোকটার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় গেলাম আমি।
উটেরিক, তোমার সময় শেষ হতে চলেছে। এবার দেখা যাবে তোমার অমরত্বের গুজব কতটুকু সত্যি, বললাম আমি। তলোয়ারের বাটে এক হাত রেখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো সে। কিন্তু সেই একই মুহূর্তে আমার দলের লোকেরা হুড়মুড় করে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। আর দ্বিধা করল না উটেরিক। চরকির মতো ঘুরে দাঁড়াল সে, তারপর জানালার কিনারায় তুলে দিল এক পা। পর মুহূর্তে জানালার ওপর উঠে দাঁড়াল সে, তার পরেই যেন উড়াল দিল শূন্যে। নিমেষের মধ্যে আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেল তার শরীরটা।
*
তীব্র ক্রোধ তার সাথে তিক্ত অসন্তোষের ছোঁয়া টের পেলাম আমি মনের ভেতর। আরো একবার প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হলো আমাকে। আক্রোশে শিকার ছিনিয়ে নেওয়া বাঘের মতো হিসিয়ে উঠলাম আমি। এটাই দুর্গের সর্বোচ্চ জায়গা। এখান থেকে একবার পড়লে কোনো মানুষের পক্ষেই জীবিত থাকা সম্ভব নয়। কামরার অন্য পাশে চলে এলাম আমি এক দৌড়ে, তারপর জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম বাইরে। অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে বুকের ভেতর, মনে হচ্ছে অনেক নিচে দলামোচড়া হয়ে পড়ে থাকতে দেখব উটেরিকের মৃতদেহটা। কিন্তু না, আমার কল্পনার সাথে কোনো অংশেই মিলল না বাস্তবের ঘটনাপ্রবাহ। বাইরে প্রায় দিনের মতো উজ্জ্বল আলো। শত শত না, বরং হাজার হাজার জ্বলন্ত মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। দুর্গের দরজা দিয়ে স্রোতের মতো হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকছে হুরোতাসের সেনাবাহিনী। রামেসিস এবং তার লোকেরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতোই পালন করেছে, ফটক খুলে দিয়েছে তারা। উটেরিকের মৃতদেহ যদি ওখানে পড়েও থাকে তাহলে সৈন্যদের পায়ের তলায় ঢাকা পড়ে গেছে এতক্ষণে।