এই সমস্ত প্রস্তুতিতে কোনো সমস্যা হলো না, নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন হলো সব কাজ। কিন্তু রামেসিসের সামনে একটা সমস্যা এসে হাজির হলো। আর সেটা হলো রানি সেরেনা ক্লিওপেট্রাকে আমাদের এই নৈশ আক্রমণে যোগ না দিতে রাজি করানো। আমরা চাইছি মাটির ওপরে হুরোতাসের সাথেই থাকুক ও, কারণ ওটাই হবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা।
তুমি বুঝতে পারছ না, টাটা, জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল রামেসিস। ও যদি একবার ভেবে বসে যে কেবল মেয়ে বলেই ওকে সাথে নিচ্ছি না আমরা এবং ওর সুরক্ষার জন্য একজন পুরুষের কাছে রেখে যাচ্ছি; তাহলে কোননাভাবেই ওকে রাজি করানো যাবে না।
আমি বুঝতে পারছি, রামেসিস, ওর গলা নকল করেই জবাব দিলাম আমি। তোমার স্ত্রীকে তো বটেই, ওর মা এবং নানিও আমার অত্যন্ত পরিচিত। ওদের সবার মাঝেই একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে দেখেছি আমি। সেটা হলো ওরা সবাই নির্দেশ দিতে ভালোবাসে; কিন্তু নিজের ওপর এসে পড়া কোনো নির্দেশ মানতে চায় না। তাই ওকে বোঝাতে হলে একটু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে তোমাকে। তুমি ওকে বলবে যে, ওর বাবার বয়স হয়েছে, চোখে ভালো না দেখাই স্বাভাবিক। তাই ঘটনাচক্রে উটেরিক যদি দুর্গ থেকে বের হয়ে পালাতে চায় তাহলে তখন তাকে চিনতে সাহায্য করার জন্যই হুরোতাসের সাথে থাকতে হবে সেরেনাকে। এমনিতেও হুরোতাস কখনো উটেরিকের চেহারা দেখেনি, অথচ সেরেনার চাইতে ভালোভাবে কেউ উটেরিককে চেনে কি না সন্দেহ। এমনকি সে যদি মুখোশ পরে থাকে তাহলেও তার হাত দেখে তাকে চিনতে পারবে সেরেনা।
পরদিন সন্ধ্যায় হুরোতাসের শিবির থেকে শেষবারের মতো রাজার সাথে আলোচনা সেরে শেয়াল দ্বীপে ফিরে এলো রামেসিস। আসার সময় পোশাকের নিচে করে বড় এক বোতল সুস্বাদু স্পার্টান মদ নিয়ে এসেছে ও। এবার সেটা থেকে এক পেয়ালা আমার দিকে ঢেলে এগিয়ে দিল ও, দাঁত বের করে হাসছে। পান করো টাটা। দুঃখকে ভুলে থাকতে হলে ইচ্ছেমতো পান করতে হবে আমাদের।
দুঃখের সংবাদ? জানতে চাইলাম আমি।
এর চাইতে ভালো কিছু হতে পারে না। তার পরই জ কুঁচকাল রামেসিস। দুঃখিত, কথাটা ভুলে বলে ফেলেছি। আমি বলতে চাইছি এর চাইতে দুঃখের কিছু হতে পারে না। আসন্ন যুদ্ধে আমার পাশে থাকতে পারবে না আমার প্রিয় স্ত্রী। সুতরাং দুর্গের প্রধান ফটকে পৌঁছানোর সংগ্রামে নিজের সর্বশক্তি এবং সবটুকু মনোযোগ ব্যয় করতে পারব আমি। ফটকের কাছে পৌঁছানোর পর আমার কাজ হবে সেটা খুলে রাখা, যাতে আমাদের বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সেরেনা থাকবে তার বাবার কাছে, যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে যেন উটেরিক পালিয়ে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে, সাহায্য করবে তার বাবাকে। আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি, হুরোতাস নিশ্চয়ই তার একমাত্র মেয়েকে কোনো বিপদে পড়তে দেবে না।
*
সব মিলিয়ে বিশাল আয়োজনের সাথে প্রস্তুতি নিতে হলো আমাদের, এবং কাজটা আরো কঠিন হয়ে উঠল আমাদের শত্রুর বহুরূপী স্বভাবের কারণে। তবে শেষ পর্যন্ত আবু নাসকোস আক্রমণের সকল প্রস্তুতিই সম্পন্ন হলো। আক্রমণের আগের রাতটা নদীর পুব তীরে পুরনো শিবিরে কাটাল রাজকীয় দম্পতি। তবে ভোর হওয়ার সাথে সাথে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল তারা। নীলনদ পার হয়ে পশ্চিম তীরে রাজা হুরোতাসের শিবিরে চলে গেল সেরেনা, আর নদীর নিচে অবস্থিত সুড়ঙ্গের মাঝে এসে অবস্থান নিল রামেসিস।
রাত নেমে আসার পর সামনে এগোতে শুরু করলাম আমরা, এবং শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম আবু নাসকোস দুর্গের নিচে অবস্থিত সেই ভূগর্ভস্থ ঘরটায়। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, নতুন চাঁদ আকাশে দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আক্রমণ শুরু করা হবে। হুরোতাস এবং অন্য যারা মাটির ওপরে ছিল তাদের জন্য অবশ্য চাঁদের দেখা পাওয়াটা খুবই সহজ হলো। তবে আমি আর রামেসিস তখন কমপক্ষে পঞ্চাশ কিউবিট মাটির নিচে। তাই শেয়াল দ্বীপের ওপরে নিয়োজিত পাহারাদারদের কাছ থেকে খবর আসার অপেক্ষায় থাকতে হলো আমাদের। সুড়ঙ্গের মুখ থেকে একেবারে ভূগর্ভস্থ ঘর পর্যন্ত সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সৈন্যরা, তাদের মুখে মুখে এসে পৌঁছাল চাঁদ ওঠার খবর।
সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম আমি আর রামেসিস, দড়ির মই বেয়ে উঠতে শুরু করলাম ওপরে। এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বাতুর আর নাসলা। আমাদের পেছনে পেছনে যারা এলো তারা সবাই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রয়েছে এবং দড়ির সাহায্যে সংযোগ রেখেছে নিজেদের মধ্যে। অন্ধকারের মধ্যে সবাই একসাথে থাকতে হলে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। শুধু দলের নেতার কাছে রয়েছে একটা করে মশাল।
এই ছোট ছোট দলগুলোর মধ্যে পাঁচটা দল রইল রামেসিসের নেতৃত্বে। ওর কাজ হচ্ছে দুর্গের প্রধান ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। সেখানে গিয়ে ফটকটা দখল করবে ওর লোকেরা, তারপর খুলে দেবে; যাতে হুরোতাস এবং হুই নিজেদের শিবির থেকে সৈন্যদের নিয়ে ঢুকে পড়তে পারে ভেতরে। একবার ওরা ভেতরে চলে আসতে পারলে দুর্গে আমাদের আক্রমণ আরো জোরদার হবে।
আমার হাতে রয়েছে বারোজনের দুটো দল। নিজের হাতে এই লোকগুলোকে বাছাই করেছি আমি, যার অর্থ হচ্ছে এদের চাইতে দক্ষ লোক পুরো সেনাবাহিনীতে নেই। নাসলা আমাদের নিয়ে যাবে দুর্গের সর্বোচ্চ অংশে, যেখানে উটেরিকের ব্যক্তিগত বসবাসের স্থান অবস্থিত। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে জীবিত গ্রেপ্তার করা, যাতে সঠিক লোকটাকে ধরা গেছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু এটাও ঠিক করে রেখেছি যে, সামান্যতম ঝামেলার আভাস দেখলেই হত্যা করা হবে তাকে। বাতুরের মতামত অনুযায়ী মাত্র দুই দিন আগেই উটেরিককে দেখা গেছে তার নিজের কামরায় ঢুকতে, এবং তারপর এখন পর্যন্ত তাকে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখেনি কেউ।