তবে রামেসিস আর আমার প্রথম কাজটা হবে মাটির নিচের বদ্ধ ঘর থেকে ছাদ ফুটো করে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা করা, যেখানে উটেরিক আর তার সঙ্গীদের বর্তমানে বসবাস। বাতুরের সাথে কথা বলে মধ্যরাতকে নির্ধারিত সময় হিসেবে ঠিক করা হয়েছে আগেই। এবার সেই সময় অনুযায়ী নাসলা এবং আরো পাঁচজন শ্রমিককে নিয়ে নীলনদের নিচের সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলাম আমরা, ঢুকে পড়লাম সেই ভূগর্ভস্থ বদ্ধ ঘরটায়। সবাইকে বললাম মোমবাতি নিভিয়ে ফেলতে, কারণ এখন আর ওগুলোর দরকার নেই আমাদের। তারপর অটুট নীরবতার মাঝে অপেক্ষা করতে লাগলাম সবাই। নিশ্চিদ্র অন্ধকার এখন আমাদের চারপাশে, সেইসাথে সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। এমনকি আমি নিজেও এই পরিস্থিতিতে কিছুটা দুর্বল বোধ করতে লাগলাম, তাহলে আমার সাথে যারা ছিল তাদের কী অবস্থা হচ্ছিল তা সহজেই অনুমেয়। একবার মনে হলো চিৎকার করে ওদের সাহস জোগাই; কিন্তু তার পরই সামলে নিলাম নিজেকে। কে জানে চিৎকার করলে হয়তো আমার নিজের মানসিক দুর্বলতা সম্পর্কে বুঝে ফেলবে ওরা।
ধীরে ধীরে সময়ের সব হিসাব হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম আমি। কিন্তু অবশেষে একসময় সেই অটুট নীরবতা ভঙ্গ হলো মাথার ওপরে কোথাও ধাতুর সাথে ধাতুর ঠোকাঠুকির অত্যন্ত মৃদু আওয়াজে। তার সাথে সাথেই শোনা গেল আমাদের লোকদের স্বস্তির নিঃশ্বাস আর উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজ। চকমকি ঠুকে মোমে আগুন ধরাল সবাই। পরবর্তী এক ঘণ্টা সময়ের মাঝে শব্দগুলো ঠিক কোন জায়গা থেকে আসছে সেটা খুঁজে বের করলাম আমরা।
আমাদের মাথার ওপর একটা জায়গায় প্রথমে সরু একটা ফুটো করে রেখেছে। বাতুর। পরে সেই ফুটো দিয়ে একটা ধাতব দণ্ড ঢুকিয়ে দিয়েছে, তারপর আরেক টুকরো ধাতব দণ্ড দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিয়েছে তাতে। এবার আমরাও সেই বরাবর একটা গজালের সাহায্যে ফুটো করতে শুরু করলাম। যদিও কাজটা বেশ কঠিন হলো, কারণ এখানে আমাদের মাথার ওপরের দেয়াল প্রায় চার কিউবিট পুরু। তবে শেষ পর্যন্ত ছিদ্র করার কাজ সম্পন্ন হলো, তাতে কান পেতে ওপাশ থেকে ভাইয়ের ফিসফিসে গলার আওয়াজ শুনতে পেল নাসলা।
এবার বাকি রইল শুধু ফুটোটাকে যথেষ্ট পরিমাণে চওড়া করে তোলার কাজ। সেটার পরিমাণ এমন হবে, যেন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ সম্পূর্ণ বর্মপরিহিত অবস্থায় তার সব অস্ত্র হাতে নিয়ে উঠতে পারে। এই কাজটা করতে আরো তিন দিনের মতো সময় লেগে গেল। তবে শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হলো কাজটা। এবার নাসলার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো আমি এবং রামেসিস পা রাখলাম আবু নাসকোস দুর্গের ভেতরে। এখানেই নাসলার বড় ভাই বাতুর আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। দুই ভাই এবার আমাদের সাথে নিয়ে দুর্গের সবচেয়ে নিচের দিকের অংশগুলো ঘুরিয়ে দেখাল। এই জায়গাগুলো বেশির ভাগই শুধু গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং মানুষ থাকে না বললেই চলে। উটেরিকের যেসব সৈন্যের সাথে আমাদের দেখা হলো তাদের বেশির ভাগই বাতুর এবং নাসলাকে খুব ভালো করেই চেনে। তা ছাড়া আমরা সবাই আগে থেকেই গোপন সংকেত জেনে নিয়েছিলাম, তাই কোনো অসুবিধাই হলো না।
এবার কিছু নির্দিষ্ট পথ আমাদের চিনিয়ে দিল দুই ভাই, যেগুলো দিয়ে দুর্গের প্রধান প্রধান অংশগুলোতে যাওয়া যায়। তারপর যে পথে ভেতরে ঢুকেছিলাম সে পথেই আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাতুর রয়ে গেল ওপাশে, কারণ আমরা যে পথটা তৈরি করেছি সেটাকে গোপন করে রাখতে হবে তাকে। এই কাজে শুকনো বার্লিভর্তি কিছু বস্তা ব্যবহার করল সে। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, পাশেরই একটা কামরায় রাখা ছিল ওগুলো।
*
এরপর আমরা যেটা করলাম তা হলো পুব তীরে হুরোতাসের পুরনো শিবির থেকে প্রায় তিন শর মতো সৈন্যকে চারটি দ্বীপে স্থানান্তর করা। এখানে ওদের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না, আবার প্রয়োজন পড়লে পানির নিচের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিয়ে আসা যাবে উটেরিকের দুর্গের ভেতরে। এই কাজগুলো যখন চলছে তখন আমি আর রামেসিস মিলে সেনাবাহিনীর সকল অধিনায়ককে ডেকে পাঠালাম, তারপর দুর্গের ভেতরের নকশা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে জানিয়ে দিলাম তাদের। এর ফলে তারা যখন সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে ঢুকবে তখন ওই বিশাল দুর্গের মাঝে তাদের পথ হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না। খুব সহজেই নিজ নিজ জায়গা খুঁজে নিতে পারবে তারা। এ ছাড়া এটাও নিশ্চিত করলাম যে, প্রত্যেকটা দলে যেন অন্তত একজন লোক থাকে যে এর আগে উটেরিককে দেখেছে এবং আবার দেখলে সাথে সাথে তাকে চিনতে পারবে। উটেরিক যে নিজের বহু নকল ব্যবহার করার মাধ্যমে শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে চায় এটা অনেক আগে থেকেই জানা হয়ে গেছে আমাদের।
এরপর সৈন্যদের বিভিন্ন দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তাদের কাজ কী হবে সে ব্যাপারে তাদের বারবার অনুশীলন করালাম আমরা। প্রথমে শেয়াল দ্বীপের সুড়ঙ্গপথ ধরে নিচে নামবে তারা, তারপর ভূগর্ভস্থ পথ ধরে পশ্চিম তীরে চলে যাবে। তারপর সেখান থেকে মাটির নিচের ঘরটা হয়ে প্রবেশ করবে দুর্গের ভেতরে। পুরো কাজটাই অন্ধকারের মাঝে করতে হবে তাদের। তাই যাওয়ার পথে দশ থেকে বারোজনের এক একটা দলে ভাগ করে দেওয়া হলো, তাদের দলের সবাইকে দড়ির সাহায্যে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিটি দলের দায়িত্বে থাকল একজন করে দলনেতা। কেবল তার হাতেই একটি করে জ্বলন্ত মশাল তুলে দেওয়া হলো।