আরো বেশ কিছু ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করা জরুরি হয়ে দাঁড়াল। মাটির কত নিচে আমাদের কাজ করতে হবে আমরা কেউই জানি না, এটাও জানি না যে আমাদের কাজের শব্দ ওপরে অর্থাৎ আবু নাসকোস দুর্গে পৌঁছে যাবে কি না। তা ছাড়া কাজটা শেষ করতে কত সময় লাগবে এবং ওই বদ্ধ জায়গার ভেতরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশজন মানুষ কীভাবে থাকবে, খাবে এবং ঘুমাবে সেটাও এখনো জানা নেই আমাদের।
একটা না একটা বুদ্ধি তুমি বের করেই ফেলবে টাটা, খুশি খুশি গলায় আমাকে বলল সেরেনা। তোমার ওপরে নিশ্চিন্তে ভরসা রাখা যায়।
কিন্তু ষোলো দিন পর, এমনকি আমিও আমার ধৈর্য এবং বুদ্ধির প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেলাম। খুব শীঘ্রই বোঝা গেল যে প্রাচীনরা তাদের এই অসাধারণ কাজকে প্রায় অসম্ভব একটা রূপ দিয়ে রেখে গেছে। বড় পাথরগুলোকে পরস্পরের সাথে আটকে রাখার জন্য কাদার মতো একধরনের নরম পদার্থ ব্যবহার করেছে তারা। সেগুলো পরে শুকিয়ে, এমনকি পাথরের চাইতেও শক্ত হয়ে গেছে। সেগুলোকে ভেঙে ভেঙে ছোট টুকরোতে পরিণত করা লাগল, তারপর হাতে হাতে বয়ে আনতে হলো সুড়ঙ্গের পেছন দিকে। হাতুড়ির শব্দ ওই বদ্ধ জায়গার ভেতর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে, কাপড় দিয়ে কান বেঁধে রাখতে বাধ্য হলো শ্রমিকরা। তার ওপর পাথরের স্তূপের মাঝে কিছু দূর পরপরই আলগা পাথরের স্তর রয়েছে, সেগুলো ধসে পড়ে আটজন শ্রমিককে হারালাম আমরা, আরো কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হলো। তারপর হঠাৎ করে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ দেখলাম যে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা। ছোট একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট গুদামঘর আর সরু গলিপথ।
দ্রুত দারুণ আগ্রহের সাথে পুরো জায়গাটা তল্লাশি করে দেখলাম আমরা। কিন্তু বেশ নিরাশ হতে হলো যখন দেখলাম যে এখানে ঢোকার বা বের হওয়ার কোনো পথ নেই, সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ। অগত্যা আবু নাসকোস দুর্গের গঠন সম্পর্কে অভিজ্ঞ নাসলাকে ডেকে নিলাম আমি, জায়গাটার অবস্থান চিহ্নিত করতে বললাম তাকে। আমার এবং রামেসিসের বদ্ধমূল ধারণা, আবু নাসকোস দুর্গ আমাদের মাথার ওপরেই রয়েছে। কিন্তু নাসলা জানাল, বড় ভাইয়ের সাথে কথা না বলে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে রাজি নয় সে। তার কথাকে যৌক্তিক বলে মনে হলো আমাদের। তাই নাসলাকে সুড়ঙ্গের ওপরে হুরোতাসের সৈন্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, যারা এখনো দুর্গ অবরোধ করে রেখেছে। একই সাথে শ্রমিকদের বেশির ভাগ অংশকে তার সাথে ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। শুধু সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং দক্ষ পাঁচজন শ্রমিককে নিজেদের সাথে রেখে দিলাম আমরা।
রামেসিস, আমি এবং সেরেনা এবার সুড়ঙ্গ ছেড়ে বাইরে শেয়াল দ্বীপের ওপরে উঠে এলাম। এখানেই অস্থায়ীভাবে আস্তানা তৈরি করলাম আমরা, নাসলা কখন তার ভাই বাতুরের সাথে কথা বলে ফিরে আসবে তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিন দিন সময় লেগে গেল তার ফিরে আসতে। ভাইয়ের সাথে সহজে যোগাযোগ করার সুযোগ পাচ্ছিল না নাসলা, তবে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে সে। দুর্গের দেয়ালের দুই পাশে বসেই দীর্ঘ সময় নিজেদের গোপন সংকেতের মাধ্যমে আলাপ করতে পেরেছে তারা।
নাসলা যে খবরগুলো নিয়ে এলো তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হলো, দুর্গের নিচে সুড়ঙ্গপথের শেষ মাথায় এসে যখন আমরা পাথরের দেয়াল ভেঙে সামনে এগোচ্ছিলাম তখন সেই শব্দ শুনতে পেয়েছে বাতুর। শব্দগুলো দারুণ চমকে দিয়েছিল তাকে। তবে রামেসিস আর আমি ঠিক করেছিলাম যে অতিরিক্ত শব্দ হওয়ার সম্ভাবনা আছে যে কাজগুলোতে সেগুলো মাঝরাতের পর করব, যখন উটেরিকের যোদ্ধারা ঘুমিয়ে থাকে অথবা পাহারায় ব্যস্ত থাকে দুর্গ প্রাচীরের ওপরে। তাই আমাদের মাটির নিচে অগ্রগতির শব্দে তেমন কোনো হইচই পড়েনি, কারণ মাঝখানের গুদামঘর এবং পাথুরে দেয়ালগুলোর কারণে শব্দ আরো কমে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবরটা হচ্ছে, দুই ভাই মিলে এমন একটা বুদ্ধি ঠিক করেছে, যার সাহায্যে বাতুরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার একটা ব্যবস্থা করতে পারব আমরা। এখন এটা পরিষ্কার যে, সুড়ঙ্গ পার হয়ে এসে প্রথম যে ফাঁকা জায়গাটায় উঠেছিলাম আমরা সেটা আসলে প্রাচীন সেনকুয়াতের রাজা জারারান্ডের তৈরি নকশারই একটি অংশ। সুড়ঙ্গের দেয়ালে এই রাজার নামই দেখেছিলাম আমরা।
অনেক শতাব্দী পর যখন সেনকুয়াত রাজ্যের সবাই মিশর ছেড়ে পালিয়ে যায় অথবা কোনো যুদ্ধের ফলে চিরতরে মুছে যায় তাদের নাম; তারপর বহু বছর খালি পড়ে ছিল এই দুর্গ। পরে তা হিকসস শাসকরা দখল করে নেয়। ওরাই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন করে বর্তমান দুর্গ গড়ে তোলে। এবং হিকসসরাই ভূগর্ভস্থ ঘরগুলোর মুখ বন্ধ করে দেয়, যেগুলোর মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম আমি আর রামেসিস। এখন এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, আবু নাসকোস দুর্গের নিচে কী লুকিয়ে আছে তা কোনোভাবেই জানা নেই উটেরিকের।
এ কথা জানার পর আবারও মাটির নিচে সেই সুড়ঙ্গে ফিরে যাওয়ার জন্য অধীর হয়ে উঠলাম আমি আর রামেসিস। সেখান থেকেই বাতুরের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে পারবে নাসলা। তারপর আমার এবং রামেসিসের দায়িত্ব হবে উটেরিকের সৈন্যদের চমকে দেওয়া এবং তাদেরই দুর্গের নিচ থেকে দলবল নিয়ে উঠে এসে তাদের ওপর হামলা চালানো। ওদের চমকে দিতে পারলে পুরো সুযোগটা থাকবে আমাদের পক্ষে। উটেরিক এবং তার চ্যালাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই চূড়ান্ত সুযোগ আমাদের সামনে। তবে এই কাজটা করার আগে রাজা হুরোতাসের সৈন্যদের সাথে সব পরামর্শ করে নিতে হবে। মাটির ওপরে দুর্গের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে তারা।