এই পৃথিবীর মানুষ জেনে রাখুক যে আমি, সেনকুয়াত এবং মেস্তানিয়ার রাজা জারারান্ড; এই গুহা নির্মাণের কাজকে উৎসর্গ করছি সকল ভালো এবং আলোকের দেবতা আহুরা মাজদার নামে…
নিজেকে সামলাতে পারলাম না আমি, হড়বড় করে বলে উঠলাম, এটা কী ভাষা সেরেনা? আর তুমি এটা শিখলে কোথায়?
মাঝপথে থেমে গিয়ে অবাক হয়ে রামেসিসের দিকে চাইল সেরেনা। তারপর বলল, তা তো ঠিক মনে নেই আমার। হঠাৎ দ্বিধা ফুটে উঠল ওর চেহারায়। বিগত বছরগুলোতে অনেকগুলো শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেছি আমি। সে জন্যই হয়তো ভুলে গেছি।
সাথে সাথেই নিজের ওপর রাগ হলো আমার। কোনো কিছু চিন্তা না করেই প্রশ্নটা করে বসেছি আমি। আমার বোঝা উচিত ছিল যে এটা আসলে দেবত্বের অধিকারী হিসেবে সেরেনার অনেকগুলো অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের একটা। এর আগের জীবনগুলোর কোনো একটায় এই ভাষা শিখেছিল সে, বর্তমান জীবনেও তার অংশবিশেষ রয়ে গেছে ওর মাঝে।
কে জানে, হয়তো তোমার স্বামীই শিখিয়েছে তোমাকে। মজা করে বললাম আমি। সাথে সাথে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল রামেসিস। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপতেই মজাটা বুঝতে পারল, তারপর হো হো করে হেসে উঠল সে।
তা ঠিক। দোষ মেনে নিচ্ছি, টাইটা। আমিই শিখিয়েছি ওকে, দাঁত বের করে হেসে বলল রামেসিস। যা যা ও জানে তার সবই আমি শিখিয়েছি। এই কথা শুনেই ওর কাঁধে ঘুষি মারল সেরেনা। হেসে উঠলাম আমরা সবাই। অস্বস্তিকর মুহূর্তটা কেটে গেল, আবার সামনে এগিয়ে চললাম আমরা। তবে কিছু দূর যাওয়ার পরেও থমকে দাঁড়াতে হলো পাথরধসের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়।
বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিলাম আমি। এর বেশি আর যাওয়ার উপায় নেই।
কী ঘটেছিল এখানে? জানতে চাইল সেরেনা।
সুড়ঙ্গের ছাদটা এখানে ধসে পড়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তা, ব্যাখ্যা করলাম আমি। এর চাইতে আর সামনে যাওয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। আমার মনে হয় এর পরে কী আছে সেটা চিরকাল একটা রহস্যই থেকে যাবে।
কিন্তু এই পাথরগুলো কি আমরা সরিয়ে ফেলতে পারি না? সেই সময়কার লোকেরা আমাদের জায়গায় হলে তো এটাই করত, তাই না? প্রশ্ন করল ও। কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে দারুণ নিরাশ হয়েছে ও।
এটা একটা পাথরধস, আবার বললাম আমি। এর ওপরে কোনো শক্ত ছাদ নেই। সোজা কথায় এটা একটা মরণফাঁদ। তুমি যদি পাথরগুলো পরিষ্কার করে এগোনোর চেষ্টা করো, বলা যায় না ওটা তোমার ওপরেই ধসে পড়তে পারে…
আমাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল রামেসিস, পাথরের স্তূপের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মেঝে থেকে শুরু করে পাথরের জমাটবাধা তূপের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল ও, একেবারে ওপরের প্রান্ত পর্যন্ত স্পর্শ করে দেখল। ছাদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হতে হলো ওকে। সেখান থেকে এক টুকরো পাথর খসিয়ে আনল ও, তারপর ফাঁকা জায়গায় হাত ভরে দিয়ে হাতড়াল কিছুক্ষণ। অবশেষে একসময় হাত বের করে এনে তাকাল আমার দিকে। একটু আগে বের করে আনা সেই পাথরের টুকরোটা এখনো ওর হাতে ধরা রয়েছে। এবার সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিল ও।
না, টাটা। জীবনে একবার হলেও ভুল হচ্ছে তোমার, আমাকে বলল রামেসিস। একে কোনোভাবেই পাথরধস বলা যায় না। ইচ্ছে করে তৈরি করা হয়েছে এটা। এই যে এই টুকরোটায় বাটালির দাগ রয়েছে। দেখেছ? ওটা বের করে আনার পর ওপরে ছাদের অস্তিত্ব টের পেয়েছি আমি। ছাদটা ধসে বা ভেঙে পড়েনি, এখনো অক্ষত আছে। এই পাথরের স্তূপ আসলে মানুষের হাতে তৈরি। পাথরগুলো ইচ্ছে করেই এখানে রাখা হয়েছে, যাতে পথ বন্ধ হয়ে যায়। কখনোই ধস নামেনি এখানে।
জবাব না দিয়ে রামেসিসের পাশ কাটিয়ে পাথরধসটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, এখনো মনে মনে ধস শব্দটাই ব্যবহার করছি। রামেসিসের চাইতে উচ্চতা বেশি আমার, ফলে ওর তৈরি করা ছিদ্রতে হাত ঢোকানোর জন্য পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হওয়া লাগল না। তবে এবার কোনো তাড়াহুড়ো করলাম না আমি। তার বদলে বেশ কষ্ট করে ধসের ওপরের অংশ থেকে আরো দুটো পাথর খসিয়ে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম সেগুলোকে। সত্যিই মানুষের হাতের ছাপ রয়েছে এগুলোতেও। তারপর ফাঁকা জায়গার মাঝে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ওপরের ছাদে কোনো ফাটল বা ফাঁকা জায়গা আছে কি না পরীক্ষা করে দেখলাম। না, তাও নেই। সম্পূর্ণ নিরেট ছাদ। পাথরের ধস নেমে বন্ধ হয়ে যায়নি সুড়ঙ্গ, বরং মানুষই ইচ্ছে করে এটাকে বন্ধ করে দিয়েছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে রামেসিসের মুখোমুখি হলাম আমি, শক্ত করলাম নিজেকে। বললাম, তুমিই ঠিক। আমার ভুল হয়েছিল। সামান্য কয়েকটা কথা; কিন্তু উচ্চারণ করা কত কঠিন।
তবে আমার কষ্টটা বুঝতে পারল রামেসিস। এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল ও। বলল, আমাদের সামনে এখনো অনেক কাজ বাকি। কখনো ভুল করলে সেটা আমি মেনে নিতে পারি না, এবং এটা রামেসিস খুব ভালো করেই জানে। তাই এখন আমার মন অন্যদিকে সরিয়ে নিতে চাইছে। সেই মুহূর্তে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল।
*
আন্দাজ করলাম, সুড়ঙ্গের নিচে যে জায়গা আছে তাতে একবারে কুড়িজনের বেশি মানুষ একসাথে কাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাধা পরিষ্কার করতে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমাদের। সিদ্ধান্ত হলো যে, শ্রমিকদের মাধ্যমে পাথরের দেয়াল থেকে একটু একটু করে পাথর সরিয়ে ফেলা হবে, তারপর তূপ করে রাখা হবে সুড়ঙ্গের দেয়াল বরাবর। এর পরও যদি জায়গার অভাব হয়ে যায় তাহলে সেগুলোকে সুড়ঙ্গ বেয়ে ওপরে তুলে নিতে হবে, ফেলে দিতে হবে নীলনদের মাঝে।