প্যাপিরাস? আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। কোথায় সেটা? দাও আমাকে, এখনই!
আমাকে ক্ষমা করে দাও টাইটা। লজ্জিত দেখাল হুরোতাসকে। কিন্তু চিঠিটা এত ভারী হয়ে গিয়েছিল যে কিছুতেই বহন করা যাচ্ছিল না। ভাবছিলাম ল্যাসিডিমনেই রেখে আসব কি না। চোখে যুগপৎ বিস্ময় আর রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি, ঠিক কীভাবে ধমকালে ওর উপযুক্ত শাস্তি হবে তাই ঠিক করার চেষ্টা করছি। তবে বেশিক্ষণ আমাকে কষ্টে রাখল না হুরোতাস, অথবা বলা যায় রাখতে পারল না। নিজেকে সামলাতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠল সে। আমি তো জানতাম এমন কাজ করলে তুমি আমাকে কী করবে টাইটা! তাই চিঠিটা আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সাথে নিয়ে এসেছি। এখন আমার কামরায় আছে সেটা।
ওর কাঁধে ঘুষি মারলাম আমি, প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই জোরে। এখনই নিয়ে এসো ওটা বদমাশ! না হলে কখনো তোমাকে ক্ষমা করব না আমি। ডেকের নিচে চলে গেল হুরোতাস, ফিরে এলো প্রায় সাথে সাথেই। সাথে রয়েছে প্যাপিরাসের বেশ ভারী একটা চিঠি। সেটা প্রায় ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম আমি, তারপর সামনের ডেকে চলে গেলাম। এখানে একাকী থাকা যাবে কিছুক্ষণ, নির্বিঘ্নে পড়া যাবে চিঠিটা।
আমার পরিচিতদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরভাবে হায়ারোগ্লিফ আঁকতে পারে আমার প্রিয় তেহুতি। আমার প্রতীক ভাঙা ডানার বাজপাখির ছবিটা এত সুন্দর করে এঁকেছে সে, মনে হচ্ছে যেন ওটা ছবি নয়, রক্ত-মাংসের তৈরি। এখনই প্রাণ ফিরে পাবে, তারপর প্যাপিরাসের ওপর থেকে উঠে আমার চোখে জমা হওয়া নোনা কুয়াশার মাঝ দিয়ে উড়ে প্রবেশ করবে আমার হৃদয়ে।
যে কথাগুলো তেহুতি লিখেছিল সেগুলো আমাকে এতই স্পর্শ করেছে যে, আর কখনো কোনো জীবিত প্রাণীর কাছে সেগুলো দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার কথা আমি ভাবতেও পারব না।
.
লুক্সর ছেড়ে আসার পর তৃতীয় দিন সকালে আমাদের নৌবহর এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল যেখান থেকে হিকসসদের দখলে থাকা মেম্ফিস শহর মাত্র বিশ লিগ উজানে। শহরটা নদীর দুই তীর জুড়ে অবস্থিত। এখানে আমাদের জাহাজগুলো চড়ায় তুলে রাখলাম আমরা, তারপর রথগুলো নামিয়ে ফেললাম। রাখালরা ঘোড়াগুলো তাড়িয়ে এনে নির্দিষ্ট দল অনুযায়ী ভাগ করে ফেলল। রথচালকরা রথের সাথে জুড়ে নিল নিজ নিজ ঘোড়াগুলোকে।
ল্যাসিডিমন বাহিনীর প্রধান জাহাজে শেষবারের মতো একবার পরামর্শে বসলাম আমরা তিনজন। এখানে আরো একবার আমাদের পরিকল্পনার সকল পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাপারগুলো আলোচনা করা হলো, মেসি আক্রমণের সময় সম্ভাব্য সকল ঝামেলা থেকে বাঁচার উপায় ঠিক করে রাখা হলো। তারপর হুই আর হুরোতাসের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি, তবে তার আগে তাদের দুজনকেই পালা করে জড়িয়ে ধরে তাদের ওপর সকল দেবতার আশীর্বাদ চেয়ে নিতে ভুললাম না। এবার নিজের রথ বাহিনী নিয়ে রওনা দিলাম লোহিত সাগরের মুখ বরাবর জায়গাগুলো অবরোধ করতে, যাতে হিকসস বাহিনী মিশর থেকে পালানোর পথ না পায়। ওরা চলে গেল আরো উত্তরে, যেখান থেকে হিকসসদের রাজা খামুদির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানাটা সহজ হবে।
মেফিস শহরের গোড়ায় অবস্থিত বন্দরে পৌঁছে হুয়োতাস আর হুই দেখতে পেল ইতোমধ্যে সেটাকে ত্যাগ করেছে খামুদি। পাথরের ঘাটে নোঙর করে থাকা সবগুলো জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে। পোড়া জাহাজগুলো থেকে যে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছিল তা এমনকি বহু লিগ দূরে সুয়েজের কাছাকাছি মিশর সীমান্তে অবস্থানরত আমার চোখেও পরিষ্কার ধরা পড়েছিল। তার পরেও প্রায় ত্রিশটি হিকসস জাহাজকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো হুরোতাস আর হুই। কিন্তু জাহাজগুলো চালানোর মতো পর্যাপ্ত নাবিক নেই আমাদের কাছে।
এবং এখানেই আমার রথ বাহিনী কাজে লাগল। সুয়েজ এবং সিনাইয়ের মাঝে মিশর সীমান্তে অবস্থান নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম, পরাজিত শহর মেফিস থেকে পালিয়ে আসা শত শত শরণার্থীকে জড়ো করতে শুরু করলাম এক জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই এদের প্রত্যেকের কাছেই ছিল অনেক মূল্যবান জিনিস।
বন্দিদের সতর্কতার সাথে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করা হলো। বৃদ্ধ এবং শিশুদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়া হলো, তারপর সিনাই মরুভূমি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। তবে তার আগে বলে দেওয়া হলো যে, এরপর আর কখনো মিশরে ফিরতে পারবে না তারা। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী এবং শক্তিশালী যারা তাদের প্রতি দশজনকে একসাথে দড়ি দিয়ে বাধা হলো, তারপর তাদের নিয়ে আবার মেফিস এবং নীলনদের দিকে যাত্রা। শুরু করলাম আমরা। তাদের মূল্যবান জিনিসপত্রগুলো এখনো আমাদের কাছেই রয়েছে। যারা আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে তাদের পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, আয়ু বেশি নেই ওদের। আমাদের যুদ্ধজাহাজে শিকলে বাঁধা অবস্থায় দাঁড় টানার কাজে খুব বেশি দিন টিকতে পারবে না কেউ। আর তা না হলে নীলনদের তীরে ফসলের ক্ষেতে ভারবাহী জন্তুর মতো কাজ করতে হবে। মেয়েগুলোর মাঝে যাদের চেহারা খুব একটা খারাপ নয় তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে পতিতালয়গুলোতে, আর তা না হলে আমাদের মিশরের প্রাসাদগুলোর রান্নাঘর অথবা ভঁড়ার ঘরে। পাশার দান উল্টে গেছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মিশরীয়দের সাথে যে আচরণ ওরা করেছিল এখন সেটাই ফেরত পাবে।