বাড়তি ওজন বইতে হওয়ায় জাহাজগুলো এত বেশি ভরে গেল যে ঘোড়াগুলোকে তোলার কোনো উপায় থাকল না। তাই যাদের ওপর প্রাণীগুলোর দায়িত্ব ছিল তাদের নির্দেশ দিলাম নীলনদের পুব তীর ধরে জাহাজবহরের সাথে সাথে ওগুলোকে নিয়ে যেতে। তারপর অন্ধকার থাকতে থাকতেই নোঙর তুললাম আমরা, ভাটি ধরে এগিয়ে চললাম হিকসস এলাকার দিকে। নদীর বাঁক এবং মোড়গুলোতে আসার সাথে সাথে সাবধান করে দিতে লাগল সারেং, প্রধান মাল্লার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ছন্দময় সংগীত। নদীর তীরে হালকা চালে ছুটে চলা ঘোড়াগুলো প্রায় বহরের সাথে সাথেই রইল, যদিও আমাদের জাহাজগুলো স্রোতের দিকে চলছে বলে বেশ দ্রুত গতিতে ছোটার সুযোগ পাচ্ছে।
.
সূর্য ওঠার আগেই প্রায় ত্রিশ লিগ পথ পাড়ি দিলাম আমরা। সূর্য উঠলে তীরে নোঙর ফেললাম, উদ্দেশ্য দিনের মাঝে সবচেয়ে গরম সময়টা বিশ্রাম নিয়ে কাটাব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘোড়ার পালগুলো যোগ দিল আমাদের সাথে, নদীর তীরে জন্মানো ফসল আর শস্যের ক্ষেতে নেমে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করল।
এসব ফসল লাগিয়েছে হিকসস চাষিরা। এখন শত্রু এলাকায় রয়েছি আমরা। চাষিদের প্রথমে তাদের উদারতার জন্য ধন্যবাদ জানানো হলো, তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো অ্যাডমিরাল হুইয়ের জাহাজগুলোতে। সেখানে দাঁড় টানার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো তাদের, মাল্লাদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে পায়ে বেঁধে দেওয়া হলো ক্রীতদাসের শিকল। মেয়েদের তুলে দেওয়া হলো হুরোতাসের সৈন্যদের হাতে। তবে তাদের কপালে কী ঘটল তা আর জানার চেষ্টা করলাম না আমি। যুদ্ধ মানেই নিষ্ঠুরতা। বিনা আমন্ত্রণেই আমাদের দেশে পা রেখেছে ওরা, আমাদের চাষিদের কাছ থেকে ফসলি জমি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ক্রীতদাস বানিয়েছে। এখন আমাদের কাছ থেকে এর চাইতে ভালো আচরণ ওরা কীভাবে আশা করে?
সব কাজ শেষ হওয়ার পর নদীর তীরে জন্মানো ডুমুর গাছগুলোর ছায়ায় বসলাম আমরা। বাবুর্চিরা নাশতা দিয়ে গেল; আগুনে ঝলসানো মাংস আর মাটির চুলায় তৈরি করা মচমচে বাদামি রুটি। সদ্য প্রস্তুত বিয়ার সহযোগে উদরপূর্তি করলাম আমরা। মনে হলো এমন তৃপ্তিসহকারে খাওয়ার জন্য আমি এমনকি ফারাওয়ের সাথে রাজকীয় ভোজে বসার সুযোগও ছেড়ে দিতে রাজি আছি। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করার সাথে সাথে জাহাজে উঠলাম আমরা। আবার শুরু হলো মেফিসের উদ্দেশ্যে আমাদের উত্তরমুখী যাত্রা। তবে এখনো প্রায় দুই দিন এভাবে চলতে হবে আমাদের। ওদিকে হুই আর হুরোতাসের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনের পর এই প্রথম ওদের সাথে আমাদের ফেলে আসা জীবন নিয়ে আলাপ করার সুযোগ পেলাম আমি। সত্যি কথা বলতে, আমি আসলে সেই দুই রাজকুমারীর খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি; ফারাও টামোসের ক্রোধ থেকে পালানোর সময় যাদের নিজেদের সাথে নিয়ে গিয়েছিল হুই আর হুরোতাস।
জাহাজের পেছনের ডেকে বসে ছিলাম আমরা। তিনজন বাদে আর কেউ নেই আশপাশে, নাবিকদের কারো আড়ি পেতে শোনার সম্ভাবনাও নেই। এবার দুজনকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে শুরু করলাম আমি।
তোমাদের দুজনকে আমি এমন কিছু প্রশ্ন করতে চাই, যেগুলোর উত্তর তোমরা দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমার তত্ত্বাবধান থেকে ফারাও টামোসের দুই অল্পবয়স্ক কুমারী বোনদের চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলে তোমরা, যাদের জন্য অনেক বেশি ভালোবাসা ছিল আমার মনে?
তোমার মাথায় যে শুধু নোংরা চিন্তাভাবনা চলে সেটা আমি জানি টাইট। আশা করা যায় আমার কথা শুনলে সেই চিন্তাগুলো দূর হয়ে যাবে, আমার প্রথম প্রশ্নটা পুরো না শুনেই বলে উঠল হুরোতাস। এখন আর ওরা অল্পবয়স্ক নয়, কুমারীও নয়।
হেসে উঠে সম্মতি জানাল হুই। তবে হ্যাঁ, প্রত্যেকটা বছরই যেন ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আরো বেশি বেড়ে চলেছে। তারা দুজনই তুলনীয় রকমের অভিজাত সত্যবাদী এবং উর্বর। আমার বেকাথা চারটে পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে আমাকে।
আর তেহুতি আমাকে উপহার দিয়েছে একটি কন্যা, যার সৌন্দর্যের কথা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, জোর গলায় বলে উঠল হুরোতাস। তবে তার মতামত নিয়ে আমার মনে কিছুটা সন্দেহ কাজ করল, কারণ আমি জানি যে প্রতিটি মা-বাবাই তাদের সন্তান সম্পর্কে অনেক লম্বা চওড়া ধারণা পোষণ করতে ভালোবাসে। আরো অনেক পরে যখন আমি প্রথমবারের মতো হুরোতাস আর তেহুতির একমাত্র কন্যাকে সচক্ষে দেখি; কেবল তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে নিজের মেয়ে সম্পর্কে আসলে কিছুই বাড়িয়ে বলেনি হুরোতাস। তেহুতি বা বেকাথা তোমাদের কাছে আমার জন্য কোনো চিঠি দিয়েছে বলে তো মনে হয় না, কণ্ঠস্বর থেকে উদাস অবটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম আমি। আমাদের যে আবার দেখা হবে এমন সম্ভাবনা তো ছিল না বললেই চলে, তা ছাড়া এতগুলো বছর পর আমার কথা কি আর ওদের মনে আছে… আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসিতে ফেটে পড়ল হুই আর হুরোতাস।
তোমাকে ভুলে যাবে ওরা? হাসির দমক কোনোমতে থামিয়ে প্রশ্ন করল হুরোতাস। তুমি কি জানো আমার স্ত্রী যেন ল্যাসিডিমন ছেড়ে মিশরে এসে তার প্রিয় টাটাকে খুঁজতে শুরু না করে সেটা নিশ্চিত করতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে? তেহুতি আমাকে আদর করে যে নামে ডাকত সেই একই নাম হুরোতাসের মুখে শুনে লাফ দিয়ে উঠল আমার বুকের ভেতরে। ওর কথাগুলো আমি মুখস্থ করে তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারব কি না এটা নিশ্চিত হতে পারেনি তেহুতি। তাই তার বদলে সব কথা প্যাপিরাসে লিখেছে, আমাকে বলেছে যেন তোমার হাতে তুলে দিই সেই চিঠি।