হিকসস সেনাবাহিনীর যে সামান্য পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য বাকি আছে তারা সবাই এখন নীলের উত্তর অববাহিকায় খামুদির রাজধানী শহর মেফিসে। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি হবে না। ওদিকে হুরোতাস এবং আমার অধীনে রয়েছে সব মিলিয়ে এর প্রায় দ্বিগুণ সৈন্য, তার সাথে কয়েক শ রথ। তবে এগুলোর প্রায় সবই ল্যাসিডিমন থেকে আগত, ফলে আমি নিজে মিশরের এবং খুব সম্ভব সভ্য পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সেনানায়ক হওয়া সত্ত্বেও সৌজন্যবোধের খাতিরে ঠিক করলাম যে, আমাদের যৌথ বাহিনীর দায়িত্ব রাজা হুরোতাসকেই দেওয়া ঠিক হবে। আমাদের আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় কেমন হবে সেটা হুরোতাসকে নির্ধারণ করার আমন্ত্রণ জানালাম আমি। এর মাধ্যমেই প্রকাশিত হলো প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে আমার অব্যাহতি নেওয়ার ইচ্ছা, সরাসরি আর মুখে বলা লাগল না আমাকে। কিন্তু হুরোতাসের মুখে সেই ছেলেমানুষি হাসিটা ফুটল আমার কথায়, বহু বছর আগে যে হাসি দেখতাম ওর মুখে। বলল, আদেশের কথা যদি বলো, কেবল একজনের সামনেই মাথা নত করতে রাজি আছি আমি। আর সেই মানুষটা এই মুহূর্তে এই টেবিলে আমার সামনেই বসে আছে। দয়া করে বলো টাইটা। তোমার যুদ্ধ পরিকল্পনার কথা শোনাও আমাদের। তোমার নেতৃত্বেই সামনে এগিয়ে যাব আমরা।
ওর বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে মাথা কঁকালাম আমি। হুরোতাস কেবল সাহসী যোদ্ধাই নয়, ওর বিচক্ষণতা কখনো অহংকারের সামনে পরাজিত হয় না। সুতরাং পরবর্তী প্রশ্নগুলো ওর উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে শুরু করলাম এবার তাহলে এবার বলো যে কীভাবে হঠাৎ করে লুক্সর এসে হাজির হলে তুমি, অথচ আমরা বা হিকসসরা- কেউই তোমার আগমনের কথা জানতে পারল না? হিকসস দুর্গ আর প্রাচীরঘেরা শহরের পাশ দিয়ে নদীর উজানে শত শত লিগ পথ পাড়ি দিয়ে বিশটা বড় বড় যুদ্ধজাহাজ নিয়ে কীভাবে এসে পৌঁছালে আমাদের কাছে?
মামুলি ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল হুরোতাস। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু সারেংকে আমি আমার জাহাজগুলোতে নিয়োগ দিয়েছি টাইটা। যদিও তোমার কাছে তাদের যোগ্যতা কিছুই নয়। নীলনদের মুখে প্রবেশ করার পর কেবল রাতের বেলায় জাহাজ চালিয়েছি আমরা, দিনের বেলায় নদীর কিনারে নোঙর করে গাছের ডাল কেটে তাই দিয়ে ঢেকে রেখেছি নিজেদের। সৌভাগ্যক্রমে আকাশের দেবী নুট সেই সময়টায় চাঁদকে ছোট রেখেছিলেন, যাতে আমরা চলাচল কারো চোখে না পড়ে। মাঝরাতের পরে নদীর তীরে অবস্থিত শত্রুদের দুর্গ পার হয়েছি আমরা এবং সব সময় মাঝ নদীতে থেকেছি। কয়েকজন জেলে হয়তো আমাদের দেখে থাকবে তবে অন্ধকারে নিশ্চয়ই আমাদের হিকসস বলে ধরে নিয়েছে তারা। এবং অত্যন্ত দ্রুত ছিল আমাদের গতি। নীলনদের মুখ থেকে রওনা দিয়ে তোমাদের সাথে যেখানে দেখা হলো সে পর্যন্ত আসতে মাত্র ছয় রাত গায়ের জোরে দাঁড় টেনেছে আমার মাল্লারা।
তার মানে ওদের চমকে দেওয়ার যে সুবিধাটা সেটা এখনো আমাদের হাতে আছে, আনমনে বলে উঠলাম আমি। গিরিপথের যুদ্ধে কিছু শত্রু যদি বেঁচে গিয়েও থাকে যদিও সেটা একেবারেই অসম্ভব- হেঁটে মেসি ফিরে সবাইকে সতর্ক করতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে ওদের। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডেকের ওপর পায়চারি করতে লাগলাম আমি। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা সেটা হলো আমরা যখন খামুদির রাজধানীতে আক্রমণ চালাব তখন কোনো শত্রুকে পালাতে দেওয়া যাবে না। যদি ওরা পালিয়ে গিয়ে সুয়েজ আর সিনাই-এর সীমান্ত পর্যন্ত চলে যেতে পারে এবং সেখান থেকে আরো পুবে ওদের জন্মভূমিতে পৌঁছে যায় তাহলে কয়েক বছর পর নতুন করে দল গঠন করে আবার আমাদের ওপর হামলা চালাতে ফিরে আসবে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ, পরাজয় আর ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার এই অভিশপ্ত চক্র চলতেই থাকবে।
ঠিক বলেছ টাইটা, আমার কথায় সম্মতি প্রদান করল হুরোতাস। এর শেষ দেখতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সদস্যরা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতি হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের জন্য যেন কোনো হিকসস হুমকি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু গল্পের এমন শুভ সমাপ্তি কীভাবে লিখব আমরা? আমার মনে হয় রথ বাহিনীকে পুব সীমান্তে মোতায়েন করা উচিত, যাতে বেঁচে যাওয়া কোনো হিকসস তাদের প্রাচীন জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে নিরাপত্তা খুঁজে নিতে না পারে, বললাম আমি।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা করল হুরোতাস, তার পরেই হঠাৎ হাসি ফুটল তার মুখে। তোমাকে পেয়ে আমরা সত্যিই সৌভাগ্যবান টাইটা। নিঃসন্দেহে আমার পরিচিত যত দক্ষ এবং অভিজ্ঞ রথচালক আছে তাদের মাঝে তুমিই সেরা। তুমি যদি সীমান্তে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নাও তাহলে একটা হিকসস কুকুরও যেন তার খোয়াড়ে ফিরে যেতে না পারে সেটা আমি অনায়াসে নিশ্চিত করতে পারব।
মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, আমার পুরনো বন্ধু হুরাতাস বোধ হয় প্রশংসার ছলে আমাকে নিয়ে মজা করে। তবে সাধারণত যেটা হয়, আমি কিছু বলি না। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
ওদিকে প্রায় মধ্যরাত গড়িয়ে গেছে; তবে অন্ধকারের কারণে আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি নিতে কোনো অসুবিধা হলো না। মশাল জ্বালিয়ে নিলাম আমরা, তারপর সেই আলোয় সবগুলো রথকে তুলে নিলাম ল্যাসিডিমন থেকে আসা জাহাজগুলোতে। তারপর জাহাজে উঠল আমাদের সৈন্যরা, তাদের সঙ্গে থাকল মিশরীয় সৈন্যদের মাঝ থেকে মুষ্টিমেয় কিছু অংশ, যারা যুদ্ধে বেঁচে গেছে।