আমার পেছনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল হুরোতাস। রাজকীয় সম্মান, টাইটা! মিশরের মহাশক্তিমান শাসক তোমাকে এই রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন!
হুরোতাসের সাথে সাথে নিজেও হাসিতে ফেটে পড়ার হাত থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম আমি, যদিও কাজটা কীভাবে করতে পারলাম আমার জানা নেই। কোনোমতে চেহারা ভাবলেশহীন রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার তলোয়ারের আঘাত ঠেকানোর জন্য ফারাওয়ের সামনে বাড়িয়ে রাখা হাতগুলোর একটা শক্ত করে ধরলাম, তারপর তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। মৃদু গলায় বললাম, আহা, ফারাও উটেরিক টুরো। আপনাকে অনেক বড় দুরবস্থার মাঝে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু মহান দেবতা হোরাস সাক্ষী, এমন কিছু করার ইচ্ছে মোটেও ছিল না আমার। এখনই নিজের কামরায় চলে যান, গোসল করে নিন। পরিষ্কার কাপড় পরুন। তবে তার আগে আমাকে এবং রাজা হুরোতাসকে অনুমতি দিন আমরা যেন আপনার সেনাবাহিনীকে নিয়ে উত্তরে নদী-অববাহিকার দিকে রওনা দিতে পারি, আক্রমণ করতে পারি হিকসসদের স্বঘোষিত রাজা খামুদির ওপর। জন্মভূমির বুক থেকে হিকসস হানাদার নামের ওই অভিশাপকে চিরতরে দূর করার শপথ নিয়েছি আমরা। আমার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল উটেরিক, পিছিয়ে গেল কয়েক পা। এখনো ভয়ার্ত হয়ে আছে তার চেহারা। জোরে জোরে কয়েকবার মাথা ঝকাল সে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁপা গলায় বলল হা! হা! এখনই যাও! অনুমতি দিচ্ছি তোমাদের। তোমার যা কিছু দরকার, যাকে যাকে দরকার সবাইকে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি যাও! বলেই ঘুরে দাঁড়াল সে, এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল রাজকীয় দরবার থেকে। প্রতিবার পা ফেলার সাথে সাথে তার জুতো থেকে ফুচুত ফুচুত শব্দ হতে লাগল।
.
দরবার কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে শহরের নির্জন রাস্ত গুলোতে ফিরে এলাম আমি আর রাজা, হুরোতাস। যদিও অভিযানের পরবর্তী ধাপে এখনই পা দেব কি না বুঝে উঠতে পারছি না; কিন্তু এটাও চাইছি না যে গুপ্তচরদের মুখে আমাদের তাড়াহুড়ো করে লুক্সর ছাড়ার খবর পৌঁছাক ফারাওয়ের কানে। নিশ্চয়ই আশপাশের বাড়িঘর আর অলিগলিতে এমন অনেক চরই লুকিয়ে আছে, নজর রাখছে আমাদের ওপর। তাই বাধ্য হয়েই ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোলাম আমরা। শেষ পর্যন্ত যখন শহরের বিজয়দ্বার নামক ফটক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম আমাদের যৌথ সেনাবাহিনী তখনো আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।
পরে শুনেছিলাম সৈনিকদের মাঝে নাকি নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং আমরা শহরের মাঝে যত বেশি সময় ছিলাম ততই সেই গুজবের মাত্রা বাড়ছিল। কেউ কেউ এমনকি এটাও বলছিল যে, আমাদের দুজনকে বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, প্রথমে ভূগর্ভস্থ কারাগার এবং পরে অত্যাচারের কক্ষে পাঠানো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাবর্তনে পোড় খাওয়া সব সৈনিকের মাঝে যে উষ্ণ প্রতিক্রিয়া দেখলাম তা সত্যিই আমার এবং রাজা হুরোতাসের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। বৃদ্ধ সৈনিক থেকে শুরু করে তরুণ পদাতিক সবার চোখে অশ্রু নামল, আমাদের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে গলা ভেঙে ফেলল সবাই। সৈন্যদের মাঝ থেকে সামনের সারিগুলো এগিয়ে এলো। আমাদের বরণ করতে, কেউ কেউ তো হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের পায়ে চুমুই খেয়ে বসল।
তার পরেই আমাদের কাঁধে তুলে নিল তারা, নীলনদের তীরে নিয়ে গেল। সেখানে ল্যাসিডিমনের নৌবাহিনী সদলবলে নোঙর করেছে। তারস্বরে বিজয়ের গান গাইতে লাগল সবাই, আমার এবং হুরোতাসের কান প্রায় বধির হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না কারো মাঝে। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, নতুন ফারাওয়ের শিশুসুলভ আচরণ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাইনি আমি, কারণ তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা কাজ করছিল আমার মাথায়। আমি ভেবেছিলাম হুরোতাস এবং আমি নিশ্চয়ই ফারাওয়ের মাথায় যথেষ্ট পরিমাণ বিচারবুদ্ধি ঢোকাতে সক্ষম হয়েছি এবং এর পরে আর তার পক্ষ থেকে তেমন কোনো ঝামেলা হবে না।
ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর প্রধান জাহাজে উঠলাম আমরা। সেখানে আমাদের স্বাগত জানাল নৌ-সেনাপতি অ্যাডমিরাল হুই। যদিও বিক্ষুব্ধ দিনটা তখন প্রায় শেষের পথে, আঁধার নেমে এসেছে দিগন্তে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই হিকসসদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযানের সর্বশেষ অধ্যায়ের পরিকল্পনায় লেগে পড়লাম আমরা। এবার যুদ্ধ হবে নীলনদের উত্তর অববাহিকায় ঘাঁটি গেড়ে বসা অবশিষ্ট যত হিকসস আছে তাদের রাজা খামুদির বিরুদ্ধে। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে আরো ভাটিতে, মেফিসে নিজের রাজধানী গড়েছে খামুদি। তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত এবং সর্বশেষ তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে আমার কাছে। মিশরের মাঝে হিকসস অধ্যুষিত এবং দখলকৃত এলাকাগুলোয় বেশ পোক্ত অবস্থানে রয়েছে আমার গুপ্তচররা।
চরদের মতে পুরো উত্তর মিশর থেকে প্রায় সকল সৈনিক এবং রথকে সরিয়ে নিয়ে তাদের দক্ষিণে পাঠিয়েছে খামুদি, ইচ্ছা যে মিশরীয় শক্তির ওপর মরণ আঘাত হেনে তাদের চিরতরে দূর করে দেবে। কিন্তু আগেই বলেছি আমি, রাজা হুরোতাসের সময়োচিত আবির্ভাবে ছেদ ঘটেছে খামুদির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়। হিকসস বাহিনীর বিরাট বড় এক অংশ এখন লুক্সরের সামনের গিরিপথে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, শেয়াল-শকুনের খাবার হচ্ছে। মিশরের বুকে হিকসস নামের দুঃস্বপ্নের চিরতরে অবসান ঘটানোর জন্য এই মুহূর্তের চাইতে সঠিক সময় আর আসবে না।