ডান হাতের তালু ওপরে তুলে ধরল উটেরিক, ফলে সাথে সাথে থেমে গেল আমার উদাত্ত বক্তৃতা। হুরোতাসের দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে, মনে হলো যেন একটু বেশিই সময় নিল কাজটা করতে। তারপর বলল, রাজা হুরোতাস, তাই না? কিন্তু একে দেখে আমার অন্য এক ব্যক্তির কথা মনে পড়ছে।
থতমত খেয়ে গেলাম আমি, এই কথার জবাবে কী বলব বুঝতে পারলাম না। এবং কোনো কথার জবাবে কিছু বলতে না পারাটা আমার সাথে একেবারেই বেমানান। এর পরেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। টামোসের সন্তানদের মাঝে যে ছিল পুরোপুরি দুর্বল অপদার্থ কিসিমের, আমার চোখের সামনেই সে পরিণত হলো উন্মত্ত ভয়ানক এক দানবে। চেহারা লাল হয়ে উঠল তার, জ্বলে উঠল চোখগুলো। প্রচণ্ড ক্রোধে কাঁপতে শুরু করল কাঁধ দুটো। আমার সঙ্গীর দিকে আঙুল তাক করল ফারাও।
আমার মহান পিতা ফারাও টামোসের সেনাবাহিনীর এক সাধারণ ক্যাপ্টেনের সাথে এই লোকের চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছি আমি; যার নাম ছিল জারাস। তুমি নিশ্চয়ই সেই গুণ্ডাটার কথা ভুলে যাওনি টাইটা? তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম, তবু এই জারাস নামের লোকটার কথা আমার ঠিকই মনে আছে। তার শয়তানিতে ভরা চেহারা আর উদ্ধত আচরণের কথা কখনো ভুলব না আমি। কণ্ঠস্বর উঁচুতে চড়ছে তার, ধীরে ধীরে মুখ থেকে থুতুর ছিটা বেরিয়ে আসছে। আমার মহান পিতা শক্তিমান ফারাও টামোস এই লোকটাকে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন ক্রিট দ্বীপে অবস্থিত রাজা মিনোসের রাজধানী নসোসে। আমার দুই ফুপু রাজকুমারী তেহুতি এবং রাজকুমারী বেকাথাকে নিরাপদে ক্রিটে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল এর ওপর। ঠিক হয়েছিল ক্রিটের রাজা মিনোসের সাথে তাদের বিয়ে হবে, যাতে আমাদের দুই রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। অথচ পথিমধ্যে এই জারাস আমার আত্মীয়দের অপহরণ করে, তারপর নিয়ে যায় পৃথিবীর একেবারে সর্বশেষ প্রান্তে এক বর্বর ভয়ানক দেশে। আর কখনো আমার দুই ফুপুর খবর জানতে পারেনি কেউ। তাদের দুজনকেই অত্যন্ত ভালোবাসতোম আমি, কী সুন্দরী ছিলেন তারা… এই পর্যায়ে এসে একের পর এক অভিযোগের তীর ছোঁড়া থামাতে বাধ্য হলো উটেরিক। নিজের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করল সে প্রাণপণ চেষ্টায়, কোনোমতে আগের সেই নির্লিপ্ত ভাবটা ফিরিয়ে আনতে চাইল। কিন্তু হুরোতাসের দিকে তুলে রাখা তার কম্পিত আঙুল একটুও নিচু হলো না।
মহামান্য ফারাও… সামনে এগিয়ে এসে বললাম আমি, দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে তার উন্মত্ত অকারণ ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ফলশ্রুতিতে একই রকম রাগ নিয়ে এবার আমার দিকে ফিরল ফারাও উটেরিক।
আর তুমি, বিশ্বাসঘাতক কুকুর! আমার বাবা আর তার সকল মন্ত্রীকে তুমি ধোকা দিতে পারো; কিন্তু আমি তোমাকে কোনো দিন বিশ্বাস করিনি। তোমার কোনো দুরভিসন্ধি বা ষড়যন্ত্র কখনো আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তোমার আসল পরিচয় আমি সেই শুরু থেকেই জানতাম। তুমি একটা দু-মুখো সাপ, মিথ্যেবাদী, কুচক্রী শয়তান… পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল সে, প্রহরীদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাল। এদের গ্রেপ্তার করো। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে ওদের মৃত্যুদণ্ড দেব আমি…
হঠাৎ যেন শক্তি হারিয়ে ফেলল ফারাওয়ের গলা। রাজকীয় দরবার কক্ষে নেমে এলো অটুট নিস্তব্ধতা।
কোথায় আমার দেহরক্ষীরা? মেয়েদের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল উটেরিক। তার কিশোর সঙ্গীরা সবাই গিয়ে সিংহাসনের পেছনে জড়ো হয়েছে, সবার চেহারা ফ্যাকাশে, ভয়ার্ত। শেষ পর্যন্ত যাকে আনেন্ত নামে ডেকেছিল উটেরিক সেই ছেলেটা কথা বলে উঠল।
তোমার রক্ষীদের তুমি নিজেই বিদেয় করে দিয়েছিলে প্রিয়। এখন আবার আমাকে বোলো না কাউকে গ্রেপ্তার করতে, বিশেষ করে এই দুই গুণ্ডাকে তো একেবারেই নয়। দেখেই মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথার খুনি এরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের দরজার পর্দা সরিয়ে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। সাথে সাথে তার পিছু নিয়ে বাকি ছেলেগুলোও বেরিয়ে গেল।
আমার প্রহরীরা কোথায়? সবাই কোথায় গেল? কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো ফারাওয়ের গলা, যেন এখনই মাফ চাইতে শুরু করবে কারো কাছে। ওদের বলেছিলাম গ্রেপ্তার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে। এখন কোথায় গেল সব? কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিতে এগিয়ে এলো না। আমাদের দুজনের দিকে তাকাল সে ভয়ার্ত চোখে, দেখল আমাদের বর্ম পরা শরীর, শক্ত হাতের মুঠোতে ধরা তলোয়ারের বাট, গম্ভীর চেহারা। সিংহাসন থেকে নেমে পর্দায় ঢাকা দরজার দিকে পিছু হঠতে শুরু করল সে। দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। সাথে সাথে প্রচণ্ড ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠল ফারাওয়ের চেহারা। ধপ করে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে রেখেছে, যেন আমার তলোয়ারের আঘাত ঠেকাতে চায়।
টাইটা, প্রিয় টাইটা, আমি তো স্রেফ ঠাট্টা করছিলাম তোমার সাথে। একটু মজা করছিলাম শুধু, তোমার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিল না আমার। তুমি তো আমার বন্ধু, আমার পরিবারের রক্ষাকর্তা। দয়া করে আমাকে মেরো না। তুমি যা বলবে তাই করব আমি… তার পরেই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। মলত্যাগ করে ফেলল উটেরিক। কাজটা সে এমন জোরালো আওয়াজ আর দুর্গন্ধের সাথে করল যে, এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। একেবারে যেন জমে গেছি, সামনে এগোনোর জন্য শূন্যে পা তুলেছি ঠিকই কিন্তু নামাতে আর মনে নেই।