এই যে আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মানুষ, চলুন ভেতরে যাই, হুরোতাসকে উদ্দেশ্য করে তিক্ত গলায় বললাম আমি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগোতে শুরু করলাম আমরা। শিরস্ত্রাণের মুখাবরণ ওপরে ওঠানো, হাত রাখা যার যার তলোয়ারের বাঁটে; এই অবস্থায় আমরা লুক্সর শহরে প্রবেশ করলাম। কেন জানি না; কিন্তু কিছুতেই নিজের মাঝে বিজয়ী সেনাপতির অনুভূতিটা আসছিল না আমার।
আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে চলল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ এবং তার কিছু সৈন্য। শহরের রাস্তাগুলো ভৌতিক রকমের নির্জন নিস্তব্ধ। নিশ্চয়ই যে দুই ঘণ্টা আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল সেই সময়টা ফারাও জনতার উৎসুক ভিড়কে সরিয়ে রাখার কাজে ব্যয় করেছেন। প্রাসাদের সামনে পৌঁছানোর পর যেন নিজেই ধীরে ধীরে খুলে গেল প্রধান ফটক। কোথাও কোনো বাজনার আওয়াজ নেই আমাদের স্বাগত জানাতে, এগিয়ে আসতে দেখা গেল না কোনো উল্লসিত জনতার ভিড়কে।
চওড়া সিঁড়ি বেয়ে রাজদরবারের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বিশাল ভবনটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা, নিস্তব্ধ। কেবল আমাদের ব্রোঞ্জে বাঁধানো জুতা ছাড়া আর কোনো কিছুর শব্দ নেই। পাথরের তৈরি সারি সারি শূন্য আসনের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমরা, কক্ষের একেবারে শেষ মাথায় উঁচু মঞ্চের ওপর রাখা সিংহাসনের দিকে এগোচ্ছি।
শূন্য সিংহাসনটার সামনে থমকে দাঁড়ালাম আমরা। আমার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। কর্কশ গলায় কোনো ভদ্রতার ধার না ধরে বলল, এখানেই দাঁড়ান! প্রায় ধমকের সুরে কথাটা বলল সে, তারপর চেহারায় কোনো পরিবর্তন না এনেই নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়তে শুরু করল। ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই কী বলা হচ্ছে বুঝে নিতে পারি আমি, তাই তার কথাগুলো বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। সে বলছে, ক্ষমা করবেন প্রভু টাইটা। আপনাদের সাথে এমন আচরণ করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে অত্যন্ত সম্মান করি।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন, বললাম আমি। নিজের দায়িত্ব তুমি খুব ভালোভাবেই পালন করেছ। আমার কথার জবাবে মুঠিবদ্ধ হাত বুকে ঠেকাল ওয়েনেগ। তারপর নিজের লোকদের নিয়ে চলে গেল সে। শূন্য সিংহাসনের সামনে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।
চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দেয়ালগুলোর ফুটো দিয়ে যে অনেকগুলো অনুসন্ধিৎসু চোখ আমাদের দিকে চেয়ে আছে সেটা হুরোতাসকে মুখে বলে দেওয়ার দরকার হলো না আমার। তার পরেও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, এই নতুন ফারাওয়ের অদ্ভুত রীতিনীতি দেখে আমার নিজের ধৈর্যও ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করেছে।
অবশেষে দূর থেকে হাসিঠাট্টা আর মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসতে লাগল তা, আরো জোরালো হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত ঝটকা দিয়ে সরে গেল সিংহাসনের পেছনে দরবার কক্ষের দরজায় ঝুলে থাকা বিশাল পর্দা। ভেতরে প্রবেশ করল ফারাও উটেরিক টুরো, নিজেকে যে মহান উটেরিক টুরো হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। চুলগুলোকে কোঁকড়া করা হয়েছে তার, এখন সেগুলো ঝুলে আছে দুই কাঁধের ওপর দিয়ে। গলায় ফুলের মালা। হাতে একটা ডালিম, সেখান থেকে দানা তুলে নিয়ে খাচ্ছে সে, আর বিচিগুলো থু থু করে ফেলে দিচ্ছে মেঝেতে। আমার এবং হুরোতাসের দিকে একবারও না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সিংহাসনের কাছে এগিয়ে গেল সে, গদি সাজিয়ে তৈরি করা আসনে বসল আরাম করে।
উটেরিক টুরোর পেছন পেছন দরবারে প্রবেশ করেছে ছয়জন অল্পবয়স্ক কিশোর, সবার পোশাক কমবেশি এলোমেলো। তাদেরকেও ফুলের সাজে সাজানো হয়েছে। ঠোঁটে লাগানো হয়েছে রক্তের মতো লাল রং, চোখের চারপাশে নীল অথবা সবুজ আভা। কেউ কেউ ফারাওয়ের মতোই কোনো ফল বা মিষ্টান্ন খাচ্ছে, তবে দু-তিনজনের হাতে মদের পেয়ালাও দেখা গেল। নিজেদের মাঝে হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত তারা, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে পেয়ালায়।
সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে একটা গদি ছুঁড়ে মারল ফারাও। মদের পেয়ালা পড়ে গেল তার হাত থেকে, ভেতরের মদটুকু ছিটকে গিয়ে লাগল গায়ের পোশাকে। হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল দরবারে।
ওহ, দুষ্টু ফারাও! ধমকে উঠল ছেলেটা। দেখো দেখি, আমার এত সুন্দর পোশাকটা একেবারে নষ্ট করে দিলে!
মাফ করে দাও প্রিয় আনেন্ত, ঢং করে চোখ ঘুরিয়ে বলল উটেরিক। এসো, বসো আমার পাশে। খুব বেশি সময় নেব না এখানে, কথা দিচ্ছি। এই দুই ভদ্রলোকের সাথে দুদণ্ড কথা বলব শুধু। দরবারে ঢোকার পরে প্রথমবারের মতো আমার এবং হুরোতাসের দিকে সরাসরি তাকাল সে। শুভেচ্ছা নাও প্রিয় টাইটা। আশা করি বরাবরের মতোই সম্পূর্ণ সুস্থ আছ তুমি? তার পরেই আমার সঙ্গীর দিকে তাকাল। বলল, আর তোমার সাথে এই লোকটা কে? আমার সাথে বোধ হয় তার পরিচয় নেই, কি বলো?
মহামান্য ফারাও, ইনি হচ্ছেন ল্যাসিডিমন রাজ্যের সর্বাধিকারী রাজা হুরোতাস। তার সাহায্য ছাড়া আপনার সোনালি শহর লুক্সরের দরজায় এসে হাজির হওয়া হিকসসদের কিছুতেই পরাজিত করতে পারতাম না আমরা। হাতটা লম্বা করে দিয়ে ইশারায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখালাম আমি। মিশরীয় সভ্যতা সম্পূর্ণভাবে বিপদমুক্ত হয়েছে এই ব্যক্তির কারণে, সে জন্য আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ…