- বইয়ের নামঃ ফারাও
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ PPP
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
ফারাও
১. তলোয়ার গিলে নিতে
ফারাও – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ: শাহেদ জামান
যদিও কথাটা মেনে নেওয়ার আগে বরং নিজের তলোয়ার গিলে নিতেই আমি বেশি পছন্দ করব; কিন্তু অন্তরের গভীরে ঠিকই বুঝতে পারলাম, সব শেষ।
পঞ্চাশ বছর আগে পুবের বন্য অঞ্চল থেকে কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই আমাদের মিশরের সীমান্তে এসে হাজির হয়েছিল হিকসসদের দল। পুরোদস্তুর বন্য এবং নিষ্ঠুর এক জাতি ওরা, ভালোর ছিটেফোঁটাও নেই কারো মধ্যে। কেবল একটা কারণেই যুদ্ধে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল তারা। আর তা হচ্ছে তাদের ঘোড়া এবং রথ, যেগুলোর কোনোটাই এর আগে কোনো মিশরীয় দেখেনি, এমনকি সেগুলোর কথাও আগে শোনেনি; এবং যেগুলোকে আমরা অত্যন্ত ভয়ানক এবং ঘৃণার বস্তু বলে ধারণা করেছিলাম।
পদাতিক সৈন্যের দল নিয়ে হিকসস আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা; কিন্তু সহজেই আমাদের হারিয়ে দিয়েছিল ওরা। রথের সাহায্যে অনায়াসে আমাদের ঘিরে ফেলা হতো, তারপর তীরের বৃষ্টি বর্ষণ করা হতো আমাদের ওপর। ফলে নৌকায় করে নীলনদের উজানে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ ছিল না আমাদের। বড় বড় জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে নৌকাগুলো টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, হারিয়ে গিয়েছিলাম বুনো প্রকৃতির মাঝে। সেখানেই জন্মভূমির জন্য শোকবিহ্বল অবস্থায় দশ বছর কাটিয়ে দিই আমরা।
সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে যাওয়ার আগে শত্রুদের অনেকগুলো ঘোড়া দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি। সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের সাথে। খুব তাড়াতাড়িই আবিষ্কার করলাম ঘোড়াগুলো আসলে ভয়ানক তো নয়ই বরং অন্যান্য প্রাণীর মাঝে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, খুব সহজেই পোষ মেনে যায়। আমার নিজের নকশায় আলাদা করে রথ তৈরি করলাম, যেগুলো হিকসসদের রথের চাইতে অনেক বেশি হালকা, দ্রুতগামী এবং সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। টামোস নামের ছেলেটি যে পরে মিশরের ফারাও পদে অভিষিক্ত হয় তাকে একজন দক্ষ রথচালক হিসেবে গড়ে তুলি আমি।
সঠিক সময় উপস্থিত হলে নৌকায় করে নীলনদ ধরে ফিরে আসি আমরা। মিশরের ঠিক কিনারায় অবতরণ করে আমাদের রথ বাহিনী, এবং সেগুলোর সাহায্যে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের উত্তরের সমভূমির দিকে বিতাড়িত করি। পরবর্তী দশকগুলোতে হিকসস শত্রুদের সাথে প্রায় নিয়মিত লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হয়েছে আমাদের।
কিন্তু এখন ভাগ্যের চাকা পুরোপুরি ঘুরে গেছে। ফারাও টামোস এখন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং হিকসস তীরের আঘাতে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছেন তার তাঁবুতে। ধীরে ধীরে কমে এসেছে মিশরীয় সৈন্যসংখ্যা। আগামীকাল সেই অবশ্যম্ভাবী নিয়তির মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
গত অর্ধ-শতাব্দীর লড়াইয়ে মিশরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য ছিল আমার সাহস। কিন্তু সেই সাহসও এখন আর যথেষ্ট নয়। গত এক বছরে পরপর দুটো বড় যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে আমাদের, দুটোই ছিল আমাদের জন্য তিক্ত এবং রক্তাক্ত এক অভিজ্ঞতা। আমাদের পিতৃভূমির বেশির ভাগ অংশ যারা দখল করে নিয়েছে সেই হিকসস অনুপ্রবেশকারীরা এখন তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিশরের প্রায় পুরোটাই এখন তাদের দখলে। হেরে যাচ্ছে আমাদের সৈন্যরা, মনোবল ভেঙে পড়ছে তাদের। আমি যতই তাদের নির্দিষ্ট অবস্থানে সাজিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিই না কেন মনে হচ্ছে যেন তারা নিজেরাই নিজেদের পরাজয় আর অসম্মান মেনে নিতে প্রস্তুত। আমাদের প্রায় অর্ধেক ঘোড়া মারা পড়েছে, যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও আর মানুষ বা রথের ওজন টানতে পারছে না। আর সৈন্যদের মাঝে প্রায় অর্ধেকের শরীরে রয়েছে তাজা ক্ষতচিহ্ন, ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে কোনোমতে বেঁধে রাখা। এর আগে বছরের শুরু থেকে যে দুটো যুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে তাতে প্রায় তিন হাজার সৈন্য হারিয়েছি আমরা। যারা বেঁচে গেছে তাদের বেশির ভাগই এখন এক হাতে তলোয়ার আর আরেক হাতে ক্যাচ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যোগ দিয়েছে যুদ্ধে।
এটা সত্যি যে, আমাদের সেনাবাহিনীর এই দৈন্যদশার পেছনে মূল কারণ যতটা না মৃত্যু বা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়া তার চাইতে বেশি সৈন্যদের পালিয়ে যাওয়া। ফারাওয়ের একসময়ের গর্বিত সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত মনোবল হারিয়ে ফেলেছে, শত্রুর সামনে থেকে দলে দলে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেছে তারা। দারুণ লজ্জায় চোখে পানি নিয়ে তাদের মিনতি করেছি আমি, এমনকি চাবুক, মৃত্যু আর অসম্মানের ভয়ও দেখিয়েছি। তবু আমার পাশ কাটিয়ে বিপুলসংখ্যক সৈন্য সরে গেছে বাহিনীর পেছনে। আমার কথায় কেউ কোনো কান দেয়নি, একবার আমার দিকে তাকায়ওনি, শুধু অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে বা খুঁড়িয়ে পালিয়ে গেছে। আর এখন লুক্সরের প্রবেশপথের ঠিক বাইরেই জড়ো হয়েছে হিকসস বাহিনী। প্রায় অবশ্যম্ভাবী এক ভয়ানক পরিণতি এড়ানোর জন্য, বলতে গেলে অত্যন্ত ক্ষীণ একটা সুযোগ রয়েছে আমাদের হাতে, আর কাল সকালে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে সেটা কাজে লাগাব আমি।