রাজ-উজিরের নিজস্ব ধারায় দুই ভাই, মেনসেট এবং সোবেকের পেছনে দাঁড়িয়েছে লসট্রিস। সুদর্শন, ভালো ব্যবহার দুজনেরই; তবে বাপের খুব বেশি প্রভাব দুটোতেই। বড় জন, মেনসেটকে বেশি অবিশ্বাস করি আমি। ছোটোটাও গিয়েছে বড়টার পথেই।
আরো পেছনে, ক্রীতদাস এবং অনুচরের সারিতে দাঁড়িয়েছি আমি, এতে করে একই সঙ্গে লসট্রিস এবং ইনটেফ দুজনের দিকেই নজর রাখতে পারছি। হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ারে ট্যানাসের সুগঠিত, লম্বা অবয়ব চোখে পড়তে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো আমার মিসট্রেসের ঘারের পেছনটা। ট্যানাসের ব্রেস্টপ্লেটে কুমীরের চামড়ার আঁশগুলো চমকাচ্ছে সূর্যরশ্মি পড়ে, মাথার হেলমেটের অসট্রিচের পালক উড়ছে গ্যালির গতির সাথে তাল মিলিয়ে।
আনন্দের আতিশায্যে মাথার উপরে দুই হাত তুলে নাচাতে লাগলো লসট্রিস, কিন্তু ফারাওকে স্বাগত জানাতে নীল নদের দুই পারে আগত জনতার গর্জনে হারিয়ে গেলো তার উল্লাস। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নগরী হলো আমাদের এই থিবেস, মনে হয়, বহু আত্মা আজ হাজির হয়েছে রাজাকে সম্মান প্রদর্শন করতে।
খোলা তরবারি স্যালুটের ভঙিতে ধরে সোজাসুজি সামনে তাকিয়ে রয়েছে ট্যানাস, ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে ফিরছে না। পাখির উড়ার ঢঙে ট্যানাসের বাহিনীর বাকি জাহাজগুলো অনুসরণ করছে হোরাসের প্রশ্বাসকে। তাদের প্রতীক, যুদ্ধে অর্জিত সম্মান সবকিছু যেনো রঙধনুর রঙে সজ্জিত আজ, উল্লাসে ফেটে পড়া জনতা পাগলের মতো হাত নাচাতে লাগল।
এর বেশ অনেক পরে রাজকীয় বাহিনীর প্রথম জাহাজ নদীর বাঁক ঘুরল। রাজার সফরসঙ্গী, ভদ্রমহিলা আর মহান পুরুষলোকে বোঝাই ওটা। এরপরে এলো আরো একটি জাহাজ, তাকে অনুসরণ করে ছোট, বড় নানা জলযানের অবিন্যস্ত কাফেলা। যেনো ঝাক বেঁধে এলো ওগুলো; প্রাসাদের চাকর-বাকর, দাস এবং তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত আসবাব, বস্ত্রসহ। রসুইঘরের জন্যে বার্জ ভর্তি গাই, ছাগল এবং মুরগি; স্বর্ণপাতে মোড়া, রঙ করা জলযানগুলোতে আরো এলো প্রাসাদের আসবাব এবং ট্রেজার, হোক তা মহান লোকেদের বা তাদের অধস্তনের; সব এক ভীষণ বিশৃঙ্খল অ নাবিকসুলভ ভঙ্গিতে সাজানো। দ্রুতগামী নীল স্রোতে জ্যামিতিক সুশৃঙ্খলতার যে উদাহরণ ট্যানাস এবং তার বাহিনী দেখাল, তা এর পাশে কত মনোজ্ঞ।
শেষমেষ ফারাও-এর রাজকীয় জলযান দারুন আড়ষ্ট, টালমাটাল ভঙ্গিতে নদীর বাকে পৌঁছুল। জনতার আর্তনাদ যেনো আকাশ বিদীর্ণ করে দেবে। বিশাল সেই জলযান, মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে বড়, ধীরে এগুতে লাগলো উজিরের প্রাসাদের নিচের ঘাটের উদ্দেশ্যে; যেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
যথেষ্ট সময় নিয়ে ওটার আকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, আমাদের এই মিশরের বর্তমান দশা এবং শাসনের অবস্থা যেনো ফুটে উঠছে জাহাজের নকশা এবং আকারে। মাতৃভূমি মিশর, ফারাও ম্রাট মামোসের শাসনের বারোতম বছরে দাঁড়িয়ে এখন, অষ্টম সম্রাট তিনি ওই বংশপরম্পরার, বলা যায় দুর্বল এবং টালমাটাল সাম্রাজ্যে তারচেয়েও দুর্বলতম শাসক তিনি। পাঁচটি যুদ্ধ গ্যালি পরপর সাজালে যতটুকু হবে, তার সমান লম্বা রাজকীয় জাহাজ; কিন্তু তার উচ্চতা এবং বিস্তার এতো অসমানুপাতিক–আমার শৈল্পিক অনুভবে আঘাত লাগল। যুগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যুদ্ধের রঙে রাঙানো হয়েছে হাল, গলুইয়ে আঁকা দেবী ওসিরিসের মুখাবয়ব সত্যিকারের স্বর্ণ পাতায় মোড়া। আমাদের আরো কাছাকাছি আসতে বোঝা গেলো, রেইলের ওপারে উজ্জ্বল রঙ চটে গেছে জায়গায় জায়গায় যেখানে বর্জ্য গড়িয়ে পড়েছে নাবিকদের।
পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে লম্বা ডেক-হাউস, মূল্যবান সিডার কাঠে তৈরি মহান ফারাও-এর ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠ ভারী আসবাবে একদম বোঝাই হয়ে আছে, জাহাজের ভারসাম্যে কোনো অবদান রাখছে না সেটা। সেই বিচিত্র স্থাপনার উপরে, তাজা পদ্মে সজ্জিত রেইলের ওপাশে দারুন ট্যান করা গ্যাজেল হরিণের চামড়ায় তৈরি দেব দেবীদের মুখচ্ছবি অঙ্কিত, আচ্ছাদনের নিচে বসে আমাদের ফারাও। রাজকীয় নিঃসঙ্গতা তার অবয়বে। স্বর্ণের স্যান্ডল, গায়ের খাঁটি লিনেনের তৈরি আচকান ভরা গ্রীষ্মের আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের মতো চমকাচ্ছে। মাথায় পরেছেন দীর্ঘ দ্বৈত মুকুট; শকুনী দেবী নেখবেট-এর অবয়বের সাদা রঙের উচ্চ সাম্রাজ্যের মুকুট, সাথে দেবী ডেল্টার লাল রঙের মুকুট।
মাথার শোভাবর্ধনকারী ওই ডেল্টা মুকুট মূলত একটা প্রহসন, দশ বছর আগেই সেই ভূখণ্ড হারিয়েছি আমরা। এই অবিন্যস্ত সময়ে নিম্ন-রাজ্যে শাসন করছেন আরো একজন ফারাও, তিনিও একটি দ্বৈত-মুকুট বা তার নিজস্ব সংস্করণ পরিধান করেন। আমাদের সাম্রাজ্যের ভয়ঙ্কর শত্রু তারা, উচ্চ এবং নিম্ন-রাজ্যের মধ্যে চলমান যুদ্ধে কত শত তরুণ যোদ্ধার প্রাণহানি হচ্ছে, ক্ষতি হয়েছে কত সম্পদের তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অন্তৰ্গত কলহ দুভাগ করে ফেলেছে মিশরকে। আমাদের মাতৃভূমির এক হাজার বছরের ইতিহাসে এমনটা হয়ে এসেছে যখনই কোনো দুর্বল ফারাও শাসন করেছেন। চির বিবদমান দুই সাম্রাজ্যকে একত্রে ধরে রাখতে হলে কঠোর, শক্তিশালী এবং চতুর সম্রাট প্রয়োজন।
প্রাসাদের ঘাটে ভীড়তে হলে টলায়মান জাহাজের চালকের উচিত ছিলো দূরের তীরের দিকে ঘেঁষে আসা, এতে করে স্রোতে পরে ভেসে আসতো জাহাজ। তেমনটি করলে নদীর পুরো প্রস্থ বরাবর ওটাকে ঘোরানো যেত বাকে। নিঃসন্দেহে বাতাস এবং স্রোতের শক্তি ঠিকমত ঠাওর করতে পারে নি চালক, মাঝ নদীতে এসে ঘুরতে শুরু করলো সে। প্রথমটায় শক্তিশালী স্রোতে পরে নাক ঘুরে গেলো জাহাজের, এরপরে উঁচু ডেক-হাউসে কামড় বসালো মরুর তীব্র বাতাস। দাড়ীদের উন্মুক্ত কাঁধে সপাসপ করে আঘাত হানা চাবুকের শব্দ মতো দূর থেকেও শোনা গেলো।