আরকুনের দু শ কি তিনশো সৈন্য রয়েছে সেখানে। পিছনে অতল গিরিখাদ। ফাঁদে পড়ে একেকজন বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। মরিয়া হয়ে সিংহের মতোই লড়ছে তারা। শিলুকদের প্রথম আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলো আমার চোখের সামনে।
ঠিক যেখানে থাকার কথা, বাহিনীর মাঝখানে ট্যানাসকে দেখতে পেলাম। শিলুক যোদ্ধাদের ভিড়ে চকচক করছে তার শিরস্ত্রাণ। আবারো আক্রমণে ধেয়ে গেলো শিলুক বাহিনী। এবারে আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না আরকুনের সৈন্যদের পক্ষে। সবার সামনে থেকে সরু বিপদজনক পথ পেড়িয়ে এলো ট্যানাস। রণসংগীত গাইছে সে। তার পিছনে এক সারিতে এগুলো শিলুক যোদ্ধারা।
অর্ধেক পথ পেরিয়ে যেতে, গান থেমে গেলো ট্যানাসের। থেমে দাঁড়ালো সে।
নিচে, সরু পথের শেষমাথায় পথ আগলে দাঁড়িয়ে একজন। আমার অবস্থান থেকে তার মুখ না দেখা গেলেও হাতের অস্ত্র ভুল হওয়ার নয়। সূর্যালোকে ঝলমল করছে নীল কিংবদন্তির তলোয়ার।
আরকুন! গর্জে উঠে ট্যানাস। চলো, লড়াইটা শেষ কোরি!
কথা না বুঝলেও ভাবটা ঠিকই ধরতে পারলো আরকুন। হেসে উঠে, মাথার উপর তলোয়ার ঘোরালো সে। সরু পাথুরে সেতুর উদ্দেশ্যে লম্বা পদক্ষেপে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো ইথিওপিয়ার স্ব-ঘোষিত রাজা।
হাতের তলোয়ারে মুঠো ঢিল দিয়ে, আমার বর্মের নিচে মাথা আংশিক আড়াল করলো ট্যানাস। চকচকে ওই নীল ফলার ধার তার জানা হয়ে গেছে, নিজের নরম ধাতুর অস্ত্র দিয়ে ওটার মোকাবিলা করার কোনোরকম ইচ্ছে নেই তার–বুঝলাম আমি। গতবার লড়াইয়ের ফলে আরকুনও একটা ব্যাপার শিখেছে। তার তলোয়ার-ধরা হাত দেখে বুঝলাম, হঠাৎ আগে বেড়ে উল্টো-পাল্টা কোনো আঘাত হানার অভিপ্রায়ে নেই সে।
পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলো তারা। শক্ত হয়ে উঠলো আরকুনের কাধ, দেহের উপর একটু ঝুঁকে সামনে এগুলো সে। সোজা ট্যানাসের গলা বরাবর আঘাত হানলো । বর্ম তুলে, ঠিক কেন্দ্র বরাবর আঘাতটা ঠেকালো ট্যানাস। যেনো ছাগলের চামড়ায় তৈরি মসৃণভাবে বর্ম ভেদ করে ঢুকে গেলো নীল ফলা। অর্ধেকটা সেঁধিয়ে গেলো তামার বর্মে। তখনই ট্যানাসের উদ্দেশ্য বোধগম্য হলো আমার কাছে। এমন ভাবে মুচড়ে দিলো সে বর্মটা, তলোয়ারের ফলাটা আটকে গেলো। অস্ত্র মুক্ত করতে আস্ফালন করে চললো আরকুন; শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পিছনে টেনে, নেচে-কুঁদে ওটা ছাড়াতে চাইলো সে। এবারে, বিপরীত দিকে না টেনে ঠিক যেদিকে টানছে আরকুন সেদিকে ঝুঁকে পরে এগোলো ট্যানাস, হঠাৎ ওপাশের টান ঢিলে হয়ে যেতে ভারসাম্য হারালো আরকুন।
অপ্রস্তুত টানা-হেঁচড়ায় মুখ থুবরে পড়ে গেলো ইথিওপিও রাজা। টলোমলো পদক্ষেপে নিচের শূন্যতার পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। অস্ত্র ছেড়ে, দুই হাত শরীরের দু পাশে মেলে দিয়ে কোনো রকমে ভারসাম্য ফিরে পেতে চাইলো আরকুন। এবারে স্থান বদল করলো ট্যানাস। বর্মের পিছনে নিজের শরীর নিয়ে সামনে ধেয়ে গেলো সে। আরকুনের বুকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো বর্ম; ট্যানাসের সমস্ত শক্তি এক করা ধাক্কাটা মাটি থেকে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো তাকে। অতল খাদের উপরে, শূন্যে ধীরে ডিগবাজী খেলো ইথিওপিও রাজার শরীর; সোজা নিচে পড়ছে সে। দেহের চারপাশে ফুলে উঠলো আলখাল্লা, সাদা দাড়ি ঝকঝক করছে সূর্যালোকে।
আমার অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, শেষযাত্রায় চলেছে আরকুন; কতো শতো অসহায় মানুষকে যে পথে পাঠিয়েছিলো সে, আজ সেই একই খাদে পড়ে শেষ হচ্ছে তার ভবলীলা দেবতাদের ইচ্ছেয়। হাজার ফুট নিচে পাথরে আছড়ে পড়ার আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত চিৎকার করলো আরকুন। তারপর সব নিস্তব্ধ।
সরুপথের উপর নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস। এখনো বর্মে গাঁথা অবস্থায় রয়েছে তলোয়ারটা।
ধীরে স্তিমিত হয়ে এলে লড়াই। নিজেদের রাজাকে খাদে পড়ে মরতে দেখেছে ইথিওপিওরা। অস্ত্র নামিয়ে রেখে প্রাণভিক্ষা চাইলো তারা। রক্তপিপাসু শিলুকদের কবল থেকে মাত্র অল্প ক জনকেই রক্ষা করতে সমর্থ হলো মিশরীয় সেনাপতিরা। তাদেরকে ধরে, দাস-শিক্ষকদের কাছে প্রেরণ করা হবে।
এসব কিছুই নয় খাদের উপরে, প্রাকৃতিক সেতুতে দাঁড়ানো ট্যানাসকে দেখছিলাম আমি। দুর্গের প্রবেশদ্বারের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো সে, অভিবাদন জানিয়ে নিজেদের অস্ত্র মাথার উপরে তুলে ধরলো সৈনিকেরা।
বুড়ো ষাঁড়টা এখনো অনেক লড়তে পারবে, গর্বে উজ্জ্বল মুখে হাসলো মেমনন। ওর আনন্দে শরীক হতে পারলাম না আমি। কোনো এক মর্মান্তিক ট্রাজেডির অশনি সংকেত বাজছে হৃদয়ে যেনো বাতাসে ঝাঁপটা মেরে নিজের শিকারের উপর বসতে যাচ্ছে শকুনের দল।
ট্যানাস, ফিসফিস করে বললাম। ধীর, এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটছে সে। পাথুরে সেতুর শেষমাথায় এসে তলোয়ারসমেত বর্মটা নামিয়ে রাখলো মিশরীয় সমরনায়ক। কেবলমাত্র তখনই তার বুকের আচ্ছাদনের রক্তের ছোপ চোখে পড়লো আমার।
মাসারাকে মেমননের হাতে সঁপে দিয়ে দৌড়ে সিঁড়িকোঠা বেয়ে নামতে লাগলাম। দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকা ইথিওপিও প্রহরীরা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো, কিন্তু তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিপদজনক পাহাড়ি সেতুর উদ্দেশ্যে ছুটলাম আমি।
আমাকে ছুটে আসতে দেখছে ট্যানাস। হাসলো ও। ধীরে থেমে দাঁড়ালো সে, পা ভাঁজ হয়ে যেতে পথের মাঝখানে ধপ করে বসে পড়লো। ওর পাশে পৌঁছে তড়িৎ ঝুঁকে পরে দেখলাম, বুকের আচ্ছাদনের কুমিরের চামড়া ফুটো হয়ে গেছে। চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে সেখান দিয়ে। আমি যা ভেবেছিলাম, নীল তলোয়ারের ফলা তার চেয়ে বেশিদূর ঢুকে গিয়েছিলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য-আরকুনের প্রথম আঘাত তামার বর্ম ফুটো করে, ট্যানাসের কুমিরের চামড়ায় তৈরি আস্তরণ ভেদ করে ওর বুকের গভীরে সেঁধিয়ে গেছে।