তাতে লেখা: পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো?
আমি জানি না, ভাবল সোফি। নিশ্চয়ই কেউ-ই আসলে জানেনা সেটা। কিন্তু তারপরেও, সোফির কাছে মনে হলো এটা একটা সঙ্গত প্রশ্ন। জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করল যে পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো এ-ব্যাপারে অন্তত প্রশ্ন না করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা ঠিক নয়। রহস্যময় চিঠি দুটো সোফির মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। সে ঠিক করল গুহায় গিয়ে বসবে।
গুহাটা সোফির খুবই গোপনীয় একটা লুকানোর জায়গা। সে যখন খুবই রেগে থাকে, খুবই কষ্টে থাকে, কিংবা খুবই খুশিতে থাকে তখন ওখানে যায় সে। আজ স্রেফ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে সে।
.
অনেকগুলো ফ্লাওয়ার বেড, ফলের ঝাড়, নানান ধরনের ফলের গাছ, একটা গ্লাইডার আর ছোট্ট একটা কুঞ্জ এ-সব নিয়ে বড়ো একটা বাগান লাল বাড়িটাকে ঘিরে আছে; জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওঁদের প্রথম সন্তান মারা গেলে দাদা এই কুঞ্জটা তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদীকে। বাচ্চাটার নাম ছিল মেরি। ওর কবরের ফলকে লেখা আছে; ছোট্ট মেরি এসেছিল মোদের কাছে, শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের সে আবার চলে গেছে।
র্যাস্পবেরি ঝাড়গুলোর পেছনে, বাগানের এক কোনায় ঘন একটা ঝোঁপ আছে, ফুল বা বেরি কোনো কিছুই জন্মায় না ওখানে। আসলে ওটা একটা পুরনো বেড়া, একসময় জঙ্গলের সীমানা নির্দেশ করত, কিন্তু গত বিশ বছরে ওটা কেউ হেঁটে টেটে দেয়নি বলে ওটা এখন জট পাকানো দুর্গম পিণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদী প্রায়ই বলতেন, যুদ্ধের সময় মুরগিগুলো যখন বাগানের মধ্যেই অবাধে ঘোরাফেরা করত তখন ওই ঝোঁপটার কারণেই শেয়ালের পক্ষে মুরগি চুরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোফি ছাড়া আর সবার কাছেই ওটা বাগানের অন্য কোনার, খরগোশের খোপগুলোর মতোই অদরকারি হয়ে পড়েছিল। তবে সেটা কেবল এই কারণে যে তারা সোফির গোপন রহস্যটা জানতে পারেনি।
সোফির স্মরণ নেই ঝোঁপটার গায়ের ছোট্ট ফোকরটার কথা সে কখনো মনে করতে পারত না কিনা। ওটার ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিলে ঝোপের ভেতরে একটা গহ্বরের মধ্যে এসে পড়ে সে। জায়গাটা ছোট্ট একটা বাড়ির মতো। ও জানে, কেউই তাকে খুঁজে পাবে না এখানে।
খাম দুটো দুহাতে আঁকড়ে ধরে বাগানের মধ্যে দিয়ে দৌড় দেয় সোফি, উবু হয়ে বসে চার হাত-পায়ে, তারপর পোকার মতো ঢুকে পড়ে বেড়ার ভেতর দিয়ে। গুহাটা এতো উঁচু যে ও প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু আজ সে দুমড়ে যাওয়া কিছু শেকড়ের একটা তূপের ওপর বসে পড়ল। এখান থেকে লতা-পাতার ক্ষুদে ক্ষুদে ছিদ্রের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাতে পারছিল সে। ছিদ্রগুলো কোনোটিই যদিও ছোট্ট একটা পয়সার চেয়ে বড় নয়, তবুও গোটা বাগানটা দিব্যি দেখতে পাচ্ছে সে। ছোটবেলায় মা-বাবা ওকে যখন গাছ-গাছালির মধ্যে খুঁজে বেড়াতেন, ও দেখে খুব মজা পেত।
এই বাগানটাকে সোফি সব সময়ই তার একান্ত নিজের জগৎ বলে ভেবে এসেছে। বাইবেলের নন্দনকাননের কথা শুনলেই সে ভাবত যে বসে বসে সে তার ছোট্ট স্বৰ্গটা নিরীক্ষণ করছে।
পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো?
বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ওর এ-ব্যাপারে। সোফি কেবল জানে পৃথিবীটা মহাশূন্যের একটা ছোট্ট গ্রহ। কিন্তু এই মহাশূন্যটাই বা এলো কোথা থেকে?
এমনও হতে পারে যে মহাশূন্যটা সবসময়ই ছিল; সেক্ষেত্রে তাকেও আর বার। করতে হবে না সেটা কোথা থেকে এলো। কিন্তু তার মনের ভেতরের কোনো একটা কিছু এ-ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বসল। যা কিছু বর্তমান রয়েছে সে-সবের নিশ্চয়ই একটা শুরু ছিল? কাজেই মহাশূন্যও নিশ্চয়ই কোনো এক সময়ে অন্য কিছু। থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু মহাশূন্য যদি অন্য কোনো কিছু থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে সেই অন্য কিছুও নিশ্চয়ই কিছু একটা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। সোফির মনে হলো প্রশ্নটা সে কেবল দীর্ঘ-ই করে যাচ্ছে। কোনো এক পর্যায়ে কোনো একটা কিছু নিশ্চয়ই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? সেটা কি ওই ব্যাপারটির মতোই অবাস্তব নয় যে আগাগোড়াই পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল? ওরা স্কুলে শিখেছে পৃথিবী ঈশ্বরের সৃষ্টি। নিজেকে সোফি এই বলে সান্ত্বনা দিতে চাইল যে এটাই সম্ভবত পুরো সমস্যটার সবচেয়ে ভালো সমাধান। কিন্তু তারপরই আবার চিন্তায় পেয়ে বসল তাকে। ঈশ্বর যে মহাশূন্য সৃষ্টি করেছেন এটা সে মেনে নিতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরের নিজের বেলা? তিনি কি নিজেই নিজেকে শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন? তার মনের গভীর থেকে আবার কে যেন প্রতিবাদ করে উঠল। সব ধরনের জিনিস ঈশ্বর তৈরি করতে পারলেও নিজেকে অন্তত তিনি তৈরি করতে পারতেন না যদি না সে-কাজটা করার আগে নিজেকে তৈরি করার জন্যে তার একটা সত্তা থাকত। কাজেই বাকি থাকে কেবল একটাই মাত্র সম্ভাবনাঃ ঈশ্বর সবসময়ই ছিলেন। কিন্তু ধারণাটা যে সে এরিমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে। অস্তিত্বশীল সব কিছুরই একটা শুরু থাকতেই হবে।
ওহ্, অসহ্য!
আবার খুলল সে খাম দুটো।
কে তুমি?
পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো?
কী বিরক্তিকর দুটো প্রশ্ন! তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার, এই চিঠি দুটোই বা কোথা থেকে এলো? এ-ব্যাপারটাও প্রায় একই রকম রহস্যময়।
তার রোজকার অস্তিত্ব থেকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে কে সোফিকে দাঁড় করিয়ে দিল মহাবিশ্বের বিশাল ধাঁধাগুলোর সামনে?