তুমি কে? জিগ্যেস করল সোফি।
এ-প্রশ্নেরও কোনো জবাব পেল না সে, তবে ক্ষণিকের জন্যে তার বুঝতে অসুবিধে হলো প্রশ্নটা সে করেছে নাকি তার প্রতিবিম্ব।
সোফি আয়নার ভেতরের নাকটার ওপর তার তর্জনী চেপে ধরে বলল, তুমি হচ্ছো আমি।
কথাটায় কোনো সাড়া না পেয়ে বাক্যটা সে ঘুরিয়ে বলল এবার, আমি হচ্ছি তুমি।
নিজের চেহারা নিয়ে মাঝে মাঝে অসন্তুষ্টিতে ভোগে সোফি। তাকে অনেকবারই বলা হয়েছে যে তার চোখ দুটো সুন্দর, পটলচেরা, কিন্তু সেটা সম্ভবত এই কারণে বলা যে তার নাকটা খুব ছোট আর মুখটা বেশ একটু বড়। আর তার কান দুটো চোখের খুব কাছাকাছি। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে তার সোজা চুল, যা দিয়ে কোনো কিছু করা অসম্ভব। মাঝে মাঝে, ক্লদ দেবুসি-র কোনো গান শোনার পর, বাবা তার চুলে হাত বুলিয়ে তাকে শনের চুলের মেয়ে বলে ডাকতেন। তিনি তা বলতেই পারেন, তাকে তো আর সোজা চুল দিয়ে জীবনযাপন করার সাজা দেয়া হয়নি। মুস (mousse) কিংবা স্টাইলিং জেল, কোনো কিছুই একবিন্দু পরিবর্তন আনতে পারেনি সোফির চুলে। মাঝে মধ্যে নিজেকে সোফির এতো কুৎসিত লাগে যে তার মনে হয় সে কোনো ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিল কিনা। তার মা তো প্রায়ই বলেন ওর জন্মের সময় তাকে কী ভীষণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কার চেহারা কেমন হবে সেটা কি এর ওপরই নির্ভর করে?
ব্যাপারটা কি খুব উদ্ভট নয় যে সে জানে না সে কে? আর এটাও কি খুব যৌক্তিক যে সে দেখতে কেমন হবে সে-ব্যাপারে তার নিজের কোনো মতামত নেয়া হয়নি? তার চেহারাটা তার ওপর স্রেফ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সে তার বন্ধু-বান্ধব পছন্দ করে নিতে পেরেছে, কিন্তু নিশ্চয়ই নিজেকে বেছে নেয়নি।
মানুষ আসলে কী?
আয়নার মেয়েটার দিকে ফের মুখ তুলে তাকাল সোফি।
আমি বরং ওপরে গিয়ে আমার বায়োলজি হোমওয়ার্ক করি, প্রায় কৈফিয়তের সুরে বলল সোফি। হল ঘরে বেরিয়ে আসার পর সে ভাবল, না, তারচেয়ে বরং বাগানে যাই।
কিটি, কিটি, কিটি।
বেড়ালটাকে তাড়িয়ে বাইরে বাড়ির দোরগোড়ার সিঁড়ির ধাপে নিয়ে এলো সোফি, তারপর বন্ধ করে দিল দরজাটা।
.
রহস্যময় চিঠিটা হাতে নিয়ে সোফি যখন নুড়ি-বিছানো পথে দাঁড়িয়ে আছে, খুবই অদ্ভুত এক চিন্তা এসে ভর করল তার ওপর। নিজেকে তার মনে হলো একটা পুতুলের মতো, একটা জাদুদণ্ড বুলিয়ে যার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করা হয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে সে যে পৃথিবীর বুকে চমৎকার এক অভিযানে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কি সত্যিই এক অসাধারণ ব্যাপার নয়!
হালকা চালে লাফিয়ে নুড়ি-বিছানো পথটা আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে গিয়ে শিয়ার্কান ঢুকে পড়ল একদঙ্গল লাল-কিশমিশ ঝোপের ভেতর। কী প্রাণবন্ত একটা বেড়াল, ওর মসৃণ শরীরের সাদা জুলফি থেকে পাকানো লেজের ডগা পর্যন্ত শক্তির ফুরণ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। এই বাগানে এখন এই বেড়ালটাও আছে, কিন্তু সোফি যেমন নিজেকে নিয়ে ভাবছে, শিয়ার্কান তা মোটেই করছে না।
বেঁচে থাকা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করতেই সোফি উপলব্ধি করতে থাকে চিরদিন সে বেঁচে থাকবে না। সে ভাবল, আমি এখন এ-পৃথিবীতে আছি, কিন্তু একদিন চলে যাবো।
মৃত্যুর পরে কি কোনো জীবন আছে? বেড়ালটা ভাগ্যবান, এই প্রশ্নটা নিয়েও একবিন্দু মাথাব্যথা নেই ওর।
সোফির দাদী মারা গেছেন বেশি দিন হয়নি। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিনই তার কথা মনে হয়েছে সোফির। এটা খুবই বাজে ব্যাপার যে জীবন ফুরিয়ে যায়!
নুড়ি-বিছানো পথের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সোফি। বেঁচে থাকা নিয়ে আরো বেশি করে ভাববার চেষ্টা করে, যাতে সে যে একদিন বেঁচে থাকবে না এ-কথাটা ভুলে যেতে পারে সে। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। যখনই সে এ-মুহূর্তে বেঁচে থাকার বিষয়টাতে মনোযোগ দিল, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর চিন্তাও এসে পড়ল তার মনের মধ্যে। উল্টোভাবেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটল; একদিন যে সে মারা যাবে এই ব্যাপারে একটা তীব্র অনুভূতি মনের মধ্যে সৃষ্টি করার মাধ্যমেই কেবল সে উপলব্ধি করতে পারল বেঁচে থাকাটা কী অসাধারণ রকমের ভালো একটা জিনিস। ব্যাপারটা যেন একটা মুদ্রার দুটো পিঠ আর, মুদ্রাটা সে বারে বারে উল্টে দিচ্ছে। সেটার একটা পিঠ যতই আরো বড় আর স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অপর পিঠটাও হয়ে উঠছে তত বড় আর ততই স্পষ্ট।
সে ভাবল, একদিন যে মারা যেতেই হবে সেটা উপলব্ধি না করে কারো পক্ষে বেঁচে থাকার ব্যাপারটা বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু এ-কথাটাও ঠিক যে, বেঁচে থাকাটা যে কী অসম্ভব রকমের আশ্চর্যের একটা ব্যাপার সেটা না ভেবে এটা উপলব্ধি করা অসম্ভব যে আমাদেরকে একদিন মরতে হবে। সোফির মনে পড়ল। দাদী অনেকটা এ-ধরনেরই একটা কথা বলেছিলেন যেদিন ডাক্তার তাকে প্রথম বললেন যে তিনি অসুস্থ। দাদী বলেছিলেন, ঠিক এই মুহূর্তটির আগে আমি বুঝতে পারিনি জীবন কত সমৃদ্ধ।
ব্যাপারটা কী দুঃখজনক যে অসুস্থ হওয়ার পরেই কেবল বেশিরভাগ লোক বুঝতে পারে বেঁচে থাকাটা কত বড় একটা উপহার। আর নয়ত তাদেরকে একটা রহস্যময় চিঠি পেতে হয় ডাকবাক্সের ভেতর।
এখন বোধহয় তার গিয়ে দেখা উচিত আর কোনো চিঠি এলো কিনা। গেটের কাছে ছুটে গিয়ে সবুজ ডাকবাক্সের ভেতর তাকাল সোফি। সেখানে ঠিক প্রথমটার মতোই আরেকটা সাদা খাম দেখে চমকে গেল সে। কিন্তু সোফি নিশ্চিত প্রথম চিঠিটা যখন সে নিয়েছিল তখন বাক্সটা খালি ছিল! এখামটার ওপরেও তার নাম লেখা। মুখ ছিঁড়ে খামটা খুলল সে, তারপর ভেতর থেকে বের করল সেই প্রথমটার আকারের একটা চিঠি।