সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রান্নার আবিষ্কারের ফলে মানুষের খাবার হজমের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। ফলে মানুষ ছোট ছোট দাঁত, অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী চোয়াল এবং ছোট খাদ্যনালী বা অন্ত্র (intestine) দিয়েও অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারল। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে রান্না করে খাবার খাওয়া শুরুর সাথে মানুষের অন্ত্র বা খাদ্যনালী ছোট হওয়া এবং মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধির সরাসরি যোগাযোগ আছে। যেহেতু দীর্ঘ অন্ত্র আর বড়সড় মস্তিষ্ক- দুটোরই অনেক বেশি বেশি শক্তির দরকার হতো চলার জন্য, তাই ও দুটো একসাথে থাকাটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাই, অন্ত্রের আকার ছোট করে তার শক্তির ব্যবহার কমিয়ে রান্না আমাদের আরও বড় মস্তিষ্কের অধিকারী প্রাণীতে রূপান্তরিত হওয়ার পথ সুগম করে দিল। আর তার ফলেই পরবর্তীতে নিয়ান্ডার্থাল আর সেপিয়েন্সের উদ্ভব হল।১
আর এ জন্যই বহু বিজ্ঞানী বলে থাকেন যে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রথম যে বড় রকম পার্থক্য তৈরি হয় সেটা আগুনের কারণেই। আগুনকে আয়ত্তে এনেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেদেরকে উঁচু পর্যায়ে উপনীত করেছে। প্রকৃতিতে প্রায় সমস্ত প্রাণীর শক্তিই মূলত তাদের শারীরিক শক্তির উপর নির্ভর করে। আর শরীরের শক্তি নির্ভর করে তার পেশীর শক্তিমত্তা কিংবা দাঁতের আকারের উপর। প্রাণীটি যদি পাখি হয় তাহলে ডানার আকৃতিও তার শক্তি জানান দেয়। যদিও এটা সত্য যে, নিজের শারীরিক শক্তির বাইরে কিছু কিছু প্রাণী প্রাকৃতিক শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু সেটার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তাদের থাকে না। যেমন, ঈগলেরা খুব সহজাতভাবেই চিহ্নিত করতে পারে কোনো জায়গায় গরম বাতাস বইছে কিনা। তখন তারা সেখানে তাদের পাখা মেলে ধরে যাতে গরম বাতাস তাদেরকে ঠেলে উপরের দিকে তোলে। কিন্তু গরম বাতাসের এই স্তরগুলো কোথায় এবং কখন তৈরি হবে এ ব্যাপারে ঈগলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি যখন পাখা মেলে তারা এই গরম বাতাস ব্যবহার করে উপরের দিকে ওঠে তখনও তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না এই বাতাসের উপর। বাতাসের কতটুকু শক্তি তারা কাজে লাগতে পারবে এটা নির্ভর করে তাদের ডানার বিস্তারের উপর, তাদের ইচ্ছের উপর নয়।
মানুষ যখন আগুনকে আয়ত্তে আনতে শিখল, তখন তারা এমন একটি শক্তির নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলো, যার সম্ভাব্য ব্যবহার অফুরন্ত। ঈগলের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই গরম বাতাসের স্তরের উপর। কিন্তু মানুষ যে কোনো সময় চাইলেই আগুন জ্বালাতে পারে। এটা মানুষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার চেয়ে বড় কথা হলো আগুনের শক্তি মানুষের শারীরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। একজন মাত্র মহিলা যে একটি বাতি বা চকমকি পাথর ব্যবহার করতে পারে, সে চাইলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরো একটি বন জ্বালিয়ে দিতে পারে। বস্তুত আগুনকে আয়ত্তে আনাটা ছিল মানুষের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা পূর্বাভাস মাত্র। সে সময় আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল আজকের আণবিক বোমা বানানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ!
হারানো ভাই-বোনের খোঁজে
আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করার পরেও প্রায় দেড় লাখ বছর আগের মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে নিজেদের খুব একটা আলাদা করে তুলতে পারেনি। হ্যাঁ, আগুনের বদৌলতে তাদের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু দক্ষতা- তারা এখন সিংহকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না, শীতের রাতে কৃত্রিম উত্তাপ উপভোগ করে, এমনকি ছোটখাট একটা জঙ্গল জ্বালিয়ে দিতেও পারে। তারপরও, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ আর আইবেরীয় উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল অঞ্চল) তখন সব মিলিয়ে মোট ১০ লাখ মানুষও ছিলো না। বিশাল বাস্তুতন্ত্রের মাঝে সেটা ছিলো নিতান্ত নগণ্য।
এ সময়টাতে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি পৃথিবীতে টিকে থাকলেও তাদের সম্পূর্ণ উপস্থিতি ছিলো কেবল আফ্রিকার এক কোণে। বিবর্তনের ঠিক কোন পর্যায় থেকে এই প্রাণীটিকে হোমো সেপিয়েন্স বলে ডাকা যায় সেটা ঠিকঠাক নির্ণয় করা যায় না। তবে এখন থেকে প্রায় দেড় লাখ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার মানুষগুলো দেখতে যে ঠিক আমাদের মতোই ছিলো- এ ব্যাপারে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই একমত। তখনকার একটা মানুষের মৃতদেহ যদি ঘটনাচক্রে আজকের কোনো মর্গে চলে আসে, সে মৃতদেহকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে কেউ বলতে পারবে না সেটা এখনকার না দেড় লাখ বছর আগের। সেই দেড় লাখ বছর আগেই মানুষের দাঁত ও চোয়াল ছোট হয়ে এসেছে, আর মস্তিষ্ক হয়েছে অনেক বড়। এর পুরো কৃতিত্ব হলো আগুনের।
বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারেও একমত যে, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে কিছু সেপিয়েন্স পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপে পৌঁছে। সেখান থেকে তারা খুব দ্রুত পুরো ইউরেশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। ইউরেশিয়া হলো ইউরোপ এবং এশিয়ার একত্রিত এলাকা।
সেপিয়েন্স যখন মধ্য প্রাচ্যে আসে তখন ইউরেশিয়ার বেশির ভাগ এলাকা অন্যান্য প্রজাতির মানুষে ভরপুর। পরবর্তী সময়ে কোথায় হারালো মানুষের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা? এ ব্যাপারে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। তার একটা হলো সঙ্কর প্রজনন (Interbreeding) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নিজের প্রজাতির সদস্য এবং অন্য প্রজাতির সদস্যদের সাথে একটি প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনা করে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আফ্রিকার মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এক প্রজাতির মানুষ আরেক প্রজাতির মানুষের সাথে প্রজননে লিপ্ত হয়। আর আজকের আধুনিক মানুষ এই সঙ্কর প্রজননের ফলাফল।