এই হলো দশ লাখ বছর আগেকার মানুষের অবস্থা। আজকের দিনেও মানুষের ইতিহাস এবং মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রায় বিশ লাখ বছর আগের কাছাকাছি সময়ে মানুষ ছিল খাদ্যচক্রের মাঝামাঝি পর্যায়ের প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমরা খাদ্যচক্রের এই মাঝামঝি অবস্থানেই অবস্থান করেছি। এটা ঠিক যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কচ্ছপ, পাখি সহ আরো ছোট ছোট প্রাণী যা পেত সব সময়ই শিকার করত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তারা অন্য বড় হিংস্র প্রাণীর শিকার হতো। মাত্র চার লাখ বছর আগে, নিয়ান্ডার্থালের মত কিছু প্রজাতির মানুষ নিয়মিতভাবেই বড় প্রাণী শিকার করা শুরু করে। আর আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে- হোমো সেপিয়েন্সের উত্থানের সময়টাতে- মানুষ হঠাৎ করে খাদ্যচক্রের একদম উপরে উঠে যায়।
খাদ্যচক্রের মধ্যম অবস্থান থেকে একলাফে মানুষের শীর্ষে ওঠার এই ঘটনা একটা বড় প্রভাব ফেলে পরবর্তীকালের পৃথিবীতে। সিংহ কিংবা হাঙরের মত খাদ্য চক্রের উপরের দিকে থাকা প্রাণীরা খুব ধীরে ধীরে তাদের ঐ অবস্থানের জন্য বিবর্তিত হয়েছিল। ঐ অবস্থানে যেতে তাদের লক্ষ লক্ষ বছর সময় লেগেছে। এর ফলে সমস্ত বাস্তুতন্ত্রটাও যথেষ্ট সময় পেয়েছিল নিজেই এমন কিছু ব্যবস্থা করতে যাতে সিংহ কিংবা হাঙরেরা সমস্ত বাস্তুতন্ত্রটা লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে না পারে। সিংহের হিংস্রতা বাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে, হরিণগুলোও শিখে নিয়েছে আরও দ্রুত দৌড়াতে, হায়েনারা অভ্যস্ত হয়েছে একে অন্যকে সাহায্য করার রীতিতে আর গণ্ডারও হয়ে উঠেছে ক্রমশ বদমেজাজী। অন্যদিকে মানুষেরা এত দ্রুত খাদ্যচক্রের উপরে উঠে এলো যে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বাস্তুতন্ত্র সবকিছু মানিয়ে নেয়ার সুযোগই পেল না। এমনকি মানুষ নিজেকেও ঠিকমত মানিয়ে নিতে পারল না এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে। এর আগে যেসব প্রাণীরা এই শীর্ষ আসনে বসেছে তারা সবাই ছিল বেশ অভিজাত, রাজকীয় প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অর্জন করা আধিপত্য তাদেরকে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল। অন্যদিকে, সেপিয়েন্স ছিল অনেকটা ভুঁইফোড় একনায়ক। কদিন আগেই তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো এক মামুলি প্রাণী থেকে হঠাৎ শীর্ষে ওঠার ফলে তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ভয় আর উৎকণ্ঠা কাজ করত নিজেদের অবস্থান হারানোর কথা ভেবে। এই অনিশ্চয়তা তাদের করে তুললো আরও নৃশংস ও ভয়ংকর। ভয়ংকর যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ইতিহাসের বড় বড় বিপর্যয়ের অনেকগুলোই সংঘটিত হয়েছে মূলত খাদ্যচক্রে মানুষের এই অপ্রত্যাশিত লাফের কারণে।
আগুনের কেরামতি, রান্নার জাদু
শীর্ষে পৌঁছানোর জন্যে মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল আগুনকে বশীভূত করা। আমরা এখনও সঠিকভাবে জানি না ঠিক কখন, কোথায় এবং কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা আগুনকে আয়ত্তে এনেছে। প্রায় আট লাখ বছর আগে হয়তো কিছু কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে আগুন ব্যবহার করত। কিন্তু প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথাল আর হোমো সেপিয়েন্সের পূর্বপুরুষরা প্রায় প্রত্যেকদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই আগুনের ব্যবহার করেছে। আগুন অন্ধকারে আলো দিয়েছে, ঠান্ডায় দিয়েছে উষ্ণতা। এমনকি সিংহ এবং ভালুকের মত বিপদজনক প্রাণীদের ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্রও ছিল আগুন। এর কিছুদিন পরেই মানুষ তার আশে পাশের বন-জঙ্গল আগুন দিয়ে পোড়ানো শুরু করে। একবার বন পোড়া শেষ হলে এবং আগুনের শিখা নিভে গেলে মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে রাস্তা করে যেতে পারত। পাওয়া যেতো আগুনে পোড়া অনেক প্রাণী যেগুলো অনায়াসে খাওয়া যেত। খাদ্যের সহজ সমাধান ছিল এই বন পোড়ানো। এটা ছিল আগুনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধা।
কিন্তু, মানুষকে রান্না করার ক্ষমতা দেয়াটাই সম্ভবত আগুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূ্র্ণ অবদান ছিলো। আমরা সাধারণত মানব জাতির ইতিহাসে রান্নাকে খুব বড় একটা পদক্ষেপ বা উন্নতি হিসেবে দেখি না। অথচ ভেবে দেখলে, মানুষের ইতিহাসে রান্নার গুরুত্ব অপরিমেয়। রান্নার ফলে প্রকৃতির খাদ্য সম্ভারে নতুন নতুন খাবারের একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। প্রকৃতিতে এমন অনেক খাবারই ছিল যেগুলো রান্না করা ছাড়া খেয়ে মানুষ হজম করতে পারত না। উদাহরণস্বরূপ, গম, আলুর মতো খাবারগুলোই মানুষ রান্না করা ছাড়া খেতে পারত না। রান্না শেখার ফলে মানুষ অনেক নতুন নতুন খাবার খাওয়া শুরু করল। আরেকটি সুবিধা হলো রান্নার ফলে জীবাণু এবং পরজীবী প্রাণী মারা যায়। বিশেষ করে মাংসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য আরও অনেক খাবারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ফলে একবার যখন মানুষ রান্না করে খাবার খাওয়া শুরু করল, তখন থেকে অনেক রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে তারা রক্ষা পেল। অন্যথায় নানা রকম জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করত, বসবাস করত, বংশবৃদ্ধি করত এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হতো। রান্না করার ফলে খাবার চিবানোর সময় কিংবা হজমের সময়টাও গেল কমে। আমাদের খুব কাছের আত্মীয়, শিম্পাঞ্জি গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা খাবার চিবোয় । তাদের পরিপাকতন্ত্র যাতে সহজে এ খাবার হজম করতে পারে এর জন্যই তারা এমনটি করে। যারা আগুন দিয়ে খারার রান্না করে খায় তাদের জন্য সারাদিনে এক ঘণ্টাই এ কাজের জন্য যথেষ্ট এবং খাবার হজম করার জন্যও তাদের অনেক কম শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয়।