কিন্তু সোজা হয়ে হাঁটার কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। আমাদের শরীরের কঙ্কালটা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে একটা চার-পেয়ে, অপেক্ষাকৃত ছোট মাথার প্রাণীর শরীরকে বহন করার জন্য। সুতরাং হঠাৎ করেই সেই কঙ্কালের পক্ষে একটি দুই পায়ে দাঁড়ানো, বড় মস্তিষ্কের প্রাণীকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্যই ছিল। আর এই কষ্টসাধ্য কাজের মূল্যও মানুষকে দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। মানুষ তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর দক্ষ হাতের বিনিময়ে কিছু কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছে- সেগুলো হল পিঠ আর ঘাড়ের ব্যথা।
মেয়েেদেরকে আরো অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে হলে কোমর হতে হবে চিকন, যা জন্ম নালীকে সরু করে দেয়। তারুপর সেটা এমন সময়ে ঘটল যখন নবজাতক বাচ্চাদের মাথার আকার বড় থেকে আরও বড় হচ্ছিল। ফলে জন্মকালীন মৃত্যুর হার আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। যেসব মহিলা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব করতে সমর্থ হয়েছে তারাই বেঁচে থাকল এবং আরো বাচ্চা নিতে সমর্থ হলো। সেইসব বাচ্চার মস্তিষ্ক এবং মাথা পুরোপুরি বড় হয়ে ওঠেনি। বিবর্তনের ধারা এইসব সময়ের পূর্বে প্রসবকারীদের প্রাধান্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখল। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানব শিশু পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করে। জন্মলাভ করার সময় বেশিরভাগ শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার যথেষ্ট সময় পায় না। একটি অশ্বশাবক জন্মের পর পরই দৌড়াতে পারে, একটি বিড়াল শাবক জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাকে ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে থাকে। সে তুলনায় মানব শিশুরা খুবই অসহায়- বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা এবং শিক্ষার জন্য বড়দের কাছে অনেক বছর তাদেরকে নির্ভরশীল থাকতে হয়।
এই সত্যটি মানব জাতির সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। নিঃসঙ্গ মায়েরা তাদের এবং বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট খাবার যোগাড় করতে পারে না। বাচ্চাকে বড় করতে হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশীদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় সবসময়। একটি মানব শিশুকে বড় করতে একটি গোত্রের প্রয়োজন হয়। বিবর্তন তাদেরই সহায়তা করেছে যারা নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে। আর তাছাড়া, মানুষ যেহেতু অপরিপক্ব অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তাই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষকে অনেক সহজে প্রয়োজন মত শিখিয়ে নেওয়া যায় এবং সামাজিক প্রাণী হিসেবে গড়ে তোলা যায়। ইট, মাটির পাত্র, চুনাপাথর ইত্যাদি পোড়ানো বা শুকানোর জন্য ব্যবহৃত চুল্লি থেকে যেভাবে চীনামাটির পাত্র বের হয় ঠিক সেভাবে বেশির ভাগ স্তন্যপায়ীর জরায়ু থেকে বাচ্চা বের হয়ে আসে। এটা একটা পরিপক্ক এবং তৈরি অবস্থায় বের হয়ে আসে। এখন আপনি যদি এই চীনামাটির ফুলদানির আকারের কোন পরিবর্তন করতে চান তবে এটাতে হয় দাগ ফেলতে হবে না হয় ভাঙতে হবে। অন্যদিকে মানুষ বের হয়ে আসে মায়ের জরায়ু থেকে ঠিক যেমন কাঁচ বের হয়ে আসে চুল্লি থেকে প্রায় গলিত অবস্থায়। চুল্লি থেকে কাঁচ বের হবার সময় বেশ নমনীয় একটা অবস্থায় থাকে বলে বের করে আনার পরও এটাকে প্যাঁচানো বা লম্বা করা কিংবা যে রকম ইচ্ছা আকার দেয়া যায়। একই ঘটনা ঘটে মানব শিশুর ক্ষেত্রেও। জন্মের পর তাকে আপনি শিক্ষাদান করতে পারেন এবং সামাজিক রীতি নীতিতে গড়ে তুলতে পারেন। আর এ জন্যই আজ আমরা একজন মানব শিশুকে চাইলেই খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ, পুঁজিবাদী কিংবা সাম্যবাদী, যুদ্ধপ্রিয় বা শান্তিপ্রিয় হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
আমরা সাধারণত অনুমান করি যে, বড় একটা মস্তিষ্ক থাকা, হাতিয়ার বা যন্ত্র বানানো এবং ব্যবহার করা, জটিল সমাজ থাকা – এগুলো বিশাল সুবিধার ব্যাপার। এটাও খুব স্পষ্ট যে, এমন সব সুযোগ সুবিধা তৈরি করার ক্ষমতা মানবজাতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মানুষ আসলে এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেছে প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে যখন তারা দূর্বল ও সাধারণ একটা প্রজাতি হিসেবে টিকে ছিল। সুতরাং প্রায় লক্ষ বছর আগে যেসব মানুষ বসবাস করত, বড় আকারের মস্তিষ্ক আর পাথরের ধারালো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা সারাক্ষণ হিংস্র জন্তুর ভয়ে তটস্থ থাকত। খুব কম ক্ষেত্রেই বড় প্রাণী শিকার করতে পারত তারা। বেশির ভাগ সময়ই তারা নানা রকম ফলমূল সংগ্রহ করে কিংবা ছোট খাটো প্রাণী শিকার করে বা কীটপতঙ্গ খুঁজে বের করে খেয়ে অথবা কোনো বড় প্রাণীর শিকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকত।
একদম প্রথম দিককার যেসব পাথরের তৈরি হাতিয়ার পাওয়া যায় সেগুলো মূলত হাড় ভেঙ্গে মজ্জা বের করার জন্যই বেশি ব্যবহৃত হতো। কিছু কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, এই অস্থিমজ্জা খাওয়াটা মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রত্যেক প্রাণীরই এরকম একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যেটা দিয়ে তাকে আলাদা করে চেনা যায়। কাঠঠোকরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেমন গাছের কাণ্ড থেকে পোকামাকড় খুঁজে বের করা, ঠিক তেমনি প্রথম দিককার মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল হাড় ভেঙ্গে তার থেকে অস্থিমজ্জা বের করে খাওয়া। মজ্জা কেন? কল্পনা করুন দশ লাখ বছর আগের কথা। ধরে নিন, আপনি সেই সময়ের একজন মানুষ। আপনি দেখলেন একদল সিংহ একটি জিরাফকে শিকার করেছে। আপনার খুব ইচ্ছে হলো জিরাফের সুস্বাদু মাংস খাওয়ার। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত সিংহের আশে-পাশে যাবেন না। কারণ, সেটা করলে শেষমেশ জিরাফের মতো আপনিও সিংহের খাবারে পরিণত হতে পারেন। সুতরাং আপনি দূরে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে থাকবেন। সবার আগে আয়েশ করে জিরাফের মাংস খেয়ে গেল সিংহ মামা। কিন্তু তখনও আপনার পালা আসেনি। সিংহের পর আসলো হায়েনা আর হিংস্র শেয়ালেরা। তারা সিংহের ফেলে যাওয়া সব খাবার খেয়ে নিল। এরপর আপনার খাবারের পালা। কিন্তু, এতক্ষণে আপনার জন্য জিরাফের হাড়ের ভেতরের অস্থিমজ্জা ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।