মগজের মাশুল
এতক্ষণ আমরা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি এবং তাদের নানারকম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানলাম। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মাঝে আকার-আকৃতি, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বিষয়ে নানারকম পার্থক্য থাকলেও তাদের সকলের মাঝেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এগুলোর মাঝে যেটা সবার আগে চোখে পড়ে, সেটা হল বড় আকারের মস্তিষ্ক। দৈহিক গঠন অনুপাতে মানুষের মস্তিষ্কের আকার অন্য যে কোন প্রাণীর থেকে বেশ বড়। সাধারণত ষাট কিলোগ্রাম ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক গড়পড়তায় দুইশ ঘনসেন্টিমিটার হয়। অন্যদিকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগের আধা-মানুষদের মস্তিষ্কের আকার ছিল প্রায় ছয়শ ঘনসেন্টিমিটার। বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আকার প্রায় এক হাজার দুইশ থেকে এক হাজার চারশ ঘনসেন্টিমিটার। মানুষের আরেকটি প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালের মস্তিষ্ক এর চেয়েও বড় আকারের ছিল।
আমরা জানি, যে সকল বৈশিষ্ট্য কোন প্রাণীকে টিকে থাকার জন্য বেশি সুবিধা দেয়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলোই সাধারণত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিকশিত হয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ কথা মনে হতেই পারে যে, মাথা বড় মানে বেশি বুদ্ধি, বেশি চিন্তাভাবনা করার সুযোগ এবং বেশি চিন্তাভাবনা করতে পারলে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং, প্রাকৃতিক বিবর্তনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বড় মাথার মানুষগুলোই টিকে থাকবে। কিন্তু, এ অনুমান যদি সত্যি হতো, তাহলে মানুষের পাশাপাশি বিড়াল, বাঘ, সিংহ এদের মাঝেও বিবর্তনের মাধ্যমে বড় বড় গণিতবিদ বা বিজ্ঞানী তৈরি হত। বাস্তবে তা হয় নি, কেবলমাত্র মানুষই বিশাল আকারের চিন্তাশীল মগজের অধিকারী হয়েছে এবং তাদের মাঝেই তৈরী হয়েছে গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, কবি এবং দার্শনিক। প্রশ্ন হল, কেন?
এক কথায় বলতে গেলে- ‘যত মাথা, তত ব্যথা’। অর্থাৎ, বড় আকারের মগজ শুধু নিরবচ্ছিন্ন সুবিধাই দেয় না, সাথে সাথে নানারকম সমস্যা ও সংকটেরও সৃষ্টি করে। বড় মগজের কাজ করার জন্য বেশি শক্তি দরকার, যেটা আসে খাদ্য থেকে। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক দেহের মোট ওজনের ২-৩ শতাংশ, কিন্তু মানুষ যখন বিশ্রামে থাকে, তখন দেহের মোট শক্তির শতকরা ২৫ ভাগ শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্যই ব্যয় হয়। অন্যদিকে, বিশ্রামকালীন সময়ে অন্যান্য নরবানরদের মস্তিষ্ক পরিচালনার জন্য দেহের মোট শক্তির মাত্র ৮ শতাংশ ব্যয় করতে হয়। এই বড় আকারের মগজের মাশুল প্রাচীনকালের মানুষদের দুইভাবে দিতে হয়েছে। প্রথমত, বড় মস্তিষ্কের জন্য খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে খাদ্য খোঁজার জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মস্তিষ্কের বড় হওয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তাদের পেশীর ক্ষয় হয়েছে, শারীরিক সামর্থ্য কমে এসেছে। সরকার যেমন সামরিক খাত থেকে বাজেট কমিয়ে শিক্ষা খাতে দেয়, তেমনি মানুষও পেশী কে শক্তিশালী না করে নিউরনকে পুষ্ট করেছে। মানুষের শিকারী-সংগ্রাহক জীবনে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটা মোটেই কোনো ভালো কৌশল ছিল না। কারণ, সেকালের একটি শিম্পাঞ্জি কখনও মানুষের সাথে তর্কে জিততে পারত না ঠিকই, কিন্তু ঐ শিম্পাঞ্জিটিই শারীরিক শক্তির কারণে একটি মানুষকে নিমেষে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত।
তবে আনন্দের কথা এই, বড় মস্তিষ্কের জন্য অনেক কাল আগে নেয়া ঝুঁকিটা আজকের এই আধুনিক সমাজে আমাদের বেশ কাজে আসছে। এর কারণে আমরা এখন গাড়ি বানাতে পারি, বন্দুক বানাতে পারি। গাড়ি আমাদেরকে শিম্পাঞ্জিদের থেকে অনেক দ্রুত চলাচল করতে সাহায্য করে আর বন্দুকের কারণে আমরা এখন শিম্পাঞ্জিদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ে না গিয়েই দূর থেকে গুলি করে তাদেরকে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু মানুষের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, গাড়ি কিংবা বন্দুক আবিষ্কার তো এই সেদিনের কাহিনী। এর আগে প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার ও ক্ষমতা ক্রমাগত বেড়েছে। কিন্তু সেই বড়সড় মগজ দিয়ে তারা শুধুমাত্র কিছু বাহারি চাকু আর কিছু বর্শা ছাড়া আর তেমন কিছুই তৈরি করতে পারেনি। উপরন্তু, বড় মস্তিষ্ক অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরী করেছে। সুতরাং, বিবর্তনের নিয়মানুযায়ী যেহেতু মানুষের বড় মস্তিষ্ক টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদেরকে তেমন কোনো সুবিধা দেয় নি, সেহেতু মগজ বড় হবার বৈশিষ্ট্যটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়ানোর ও বিকাশ লাভ করার কথা নয়। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেটাই হয়ে এসেছে। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও জানি না।
বড় মস্তিষ্কের পর মানুষের সব প্রজাতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখতে পাই তা হল, তারা সবাই দুই পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটে। মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে আশপাশের শত্রু বা শিকারের সন্ধান করা অনেকটা সহজ হয়ে গেল। এছাড়াও এর ফলে আমাদের দুটো হাত হাঁটার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে পাথর ছুঁড়ে মারা বা অন্যকে ইশারা দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে লাগল। যার হাত যত বেশি দক্ষ, সমাজে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। সে কারণে, বহু বছরের বিবর্তনের ফলে ক্রমাগত সূক্ষ্ম পেশী, অধিকতর স্নায়ু সংযোগ, সূক্ষ্ম কাজের জন্য উপযুক্ত হাতের তালু ও আঙ্গুল সমৃদ্ধ মানুষের বিকাশ হতে থাকল। ফলশ্রুতিতে মানুষ তার হাত দিয়ে অনেক সূক্ষ্ম কাজ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে শিখল। বিশেষ করে, উন্নত এই হাত তাদেরকে অনেক সূক্ষ্ম অস্ত্র তৈরি এবং ব্যবহারের সুযোগ করে দিল। সবচেয়ে পুরনো এরকম যে হাতিয়ারটি পুরাতত্ত্ববিদেরা পেয়েছেন সেটা প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগের। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ঐ সময় থেকেই হাতে বানানো হাতিয়ারের প্রচলন ছিল।