এবারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মানুষের আরেকটি প্রজাতি বিকাশ লাভ করে যাদেরকে বলা হয় হোমো সলোয়েনসিস (Homo soloensis) বা সলো উপত্যকার মানুষ। এদিকে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস নামের ছোট্ট একটি দ্বীপে তখন লেখা হচ্ছে ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিকাশ হচ্ছে ছোট আকারের এক প্রজাতির মানুষের, সেপিয়েন্স প্রজাতির বিজ্ঞানীরা অনেক পরে যার নাম দেবেন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (Homo floresiensis) বা ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ। মানুষ যখন প্রথম ফ্লোরেস দ্বীপে পৌঁছায় তখন সমু্দ্রের পানির উচ্চতা ছিল একেবারেই কম। ফলে মানুষ সহজেই ফ্লোরেস থেকে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করতে পারত। সময় যতই অতিবাহিত হল সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকল। একসময় ফ্লোরেস দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এর ফলে কিছু লোকজন ফ্লোরেস দ্বীপেই আটকা পড়ে গেল। ফ্লোরেস ছিল খুবই ছোট একটি দ্বীপ। এরকম ছোট একটি দ্বীপে অনেক লোকের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবারের সরবরাহ থাকে না। ফলে লম্বা এবং মোটা-তাজা লোকজন, বেশি বেশি খাবার ছাড়া যাদের চলে না, প্রথমেই তারা খাবারের অভাবে মারা পড়ল। কিন্তু ছোট-খাট লোকজন এবং প্রাণী, যাদের বেঁচে থাকার জন্য কম খাবারের প্রয়োজন হয় তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকল।
অনেক অনেক বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে চলল। ছোট আকারের মানুষদের কম খাবার খেয়েও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল। এ কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছোট আকারের মানুষরাই বেশি সংখ্যায় টিকে থাকল। এভাবে ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ একসময় বামনে (ছোট আকারের মানুষ) পরিণত হল। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সর্বোচ্চ এক মিটার (৩ ফুট) উচ্চতার এবং ২৫ কিলোগ্রাম ওজনের হত। কিন্তু, আকারে ছোট হলেও তারা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির মতই বর্শাসহ পাথরের নানারকম হাতিয়ার তৈরি করতে পারত এবং এসব হাতিয়ার দিয়ে তারা মাঝে মাঝে হাতিও শিকার করত! যদিও, সত্যি কথা বলতে কী, সেই হাতি অন্যান্য এলাকার হাতির মত দশাসই আকারের হাতি ছিল না, ছিল বামন হাতি! এই হল বামনরাজ্য ফ্লোরেস এর গল্প।
২০১০ সালে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় খননকাজ চালাতে গিয়ে মানুষের একটি আঙ্গুলের ফসিলের সন্ধান পান যা কিছুদিন পর আমাদের সামনে নিয়ে আসে মানুষের হারিয়ে যাওয়া আরেকটি প্রজাতিকে। জিনগত গবেষণা থেকে বোঝা যায়, এই ফসিলটি থেকে প্রাপ্ত জিন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মানুষের সবগুলো প্রজাতির থেকে আলাদা। বিজ্ঞানীরা মানুষের নতুন এই প্রজাতির নাম দিয়েছেন হোমো ডেনিসোভা (Homo denisova) বা ডেনিসোভা গুহার মানুষ। কে জানে- কোন দেশে, কোন অচেনা গুহায়, কোন নির্জন দ্বীপে মানুষের নাম না জানা কত প্রজাতির নিদর্শন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আবিষ্কৃত হওয়ার প্রত্যাশায়।
যখন ইউরোপ এবং এশিয়ায় বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের এসব নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে, তখন পূর্ব আফ্রিকাতেও কিন্তু বিবর্তন থেমে থাকে নি। সেখানেও মানবজাতির আঁতুড়ঘরে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন প্রজাতি। তৈরি হয়েছে হোমো রুডলফেনসিস (Homo rudolfensis) বা রুডলফ হ্রদের মানুষ, হোমো ইরগেস্টার (Homo ergaster) বা কর্মঠ মানুষ এবং সব শেষে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রজাতি, নিজেদেরকে যারা হোমো সেপিয়েন্স বা জ্ঞানী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর মাঝে কিছু ছিল বিশাল আকারের, কেউ ছিল বামন। কেউ কেউ ছিল তুখোড় শিকারী আবার কেউ শুধু ফল-মূল খেয়েই বেঁচে থাকত। কোনো প্রজাতি একটি দ্বীপের মধ্যেই সারাটা জীবন কাটিয়েছে, কেউ আবার ভ্রমণ করেছে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ। কিন্তু তারা সকলেই ছিল এক মানব জাতির অংশ। তারা সবাই ছিল মানুষ।
মানুষের এই বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা হল, মানুষের একাধিক প্রজাতি একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে কখনোই একসাথে বসবাস করেনি, বরং প্রজাতিগুলোর একটি থেকে অপরটির জন্ম হয়েছে। যেমন, ইরেকটাস এর জন্ম হয়েছে ইরগেস্টার থেকে, নিয়ান্ডার্থালের জন্ম হয়েছে ইরেকটাস থেকে এবং নিয়ান্ডার্থাল থেকে আমরা এসেছি। মানুষের একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির তৈরি হবার এই ধারণা আমাদের এটা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে যে, মানুষের একের অধিক প্রজাতি কখনও একসাথে পৃথিবীর বুকে বসবাস করে নি, একটি নতুন প্রজাতি মানুষের পূর্ববর্তী আরেকটি প্রজাতির উন্নত সংস্করণ মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হল, ২০ লাখ বছর আগে থেকে শুরু করে ১০ হাজার বছর আগেও পৃথিবী ছিল মানুষের অনেকগুলো প্রজাতির বাসভূমি। কেন নয়? আজকের পৃথিবীতে একই সময়ে অনেক প্রজাতির শেয়াল, ভালুক আর শুকর বসবাস করছে। একইভাবে এক লাখ বছর আগের পৃথিবীতে একই সাথে মানুষরে অন্তত ছয়টি প্রজাতি হেঁটে বেড়িয়েছে, বসবাস করেছে পৃথিবীর বুকে। প্রাণীজগতে অন্যান্যদের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, একসাথে একাধিক প্রজাতির সহাবস্থানের ব্যাপারটাই স্বাভাবিক, বরং আজকের আধুনিক বিশ্বে যে মানুষের কেবল একটি প্রজাতি বসবাস করছে সেই ব্যাপারটি অস্বাভাবিক, খাপছাড়া। একটু পরেই আমরা দেখব, আধুনিক মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থেই মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোর ইতিহাস ধামাচামা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।