যেসব প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে তাদেরকে একই ‘গণ’ বা ‘জাতি’র (Genus, বহুবচন Genera) অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। সিংহ, বাঘ, চিতা এবং জাগুয়ার এরা প্রত্যেকেই প্যানথেরা (Panthera) নামক জাতের আলাদা আলাদা প্রজাতি। জীববিজ্ঞানীরা প্রাণীদের নামকরণ করেন দুইটি পৃথক ল্যাটিন শব্দের মাধ্যমে। আগে গণ বা জাতির নাম, পরে প্রজাতির নাম। যেমন, সিংহের নাম প্যানথেরা লিও (Panthera leo) যার অর্থ প্যানথেরা শ্রেণীর সিংহ প্রজাতি। ধরে নেওয়া যায়, এ বই যারা পড়বে তাদের প্রত্যেকেই হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) অর্থাৎ মানুষ (Homo অর্থ মানুষ) শ্রেণীর জ্ঞানী (sapiensঅর্থ জ্ঞানী) প্রজাতির।
কয়েকটি ‘গণ’ আবার একটি ‘পরিবার’ (Family) তৈরি করে। যেমন- সিংহ, চিতা বাঘ, পোষা বিড়াল – এরা বিড়াল পরিবারভুক্ত; নেকড়ে, খেঁকশিয়াল এবং শেয়াল – এরা কুকুর পরিবারের সদস্য এবং হাতি, ম্যামথ, মাসটোডোন – এরা হাতি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একই পরিবারের সমস্ত সদস্য অতীতের কোনো পিতৃতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী থেকে বিকাশ লাভ করেছে বা বিবর্তিত হয়েছে। গৃহস্থের আদরের পোষা বিড়াল এবং বনের হিংস্র বাঘ আসলে একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভুত, প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছিল যাদের বসবাস।
জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানুষও অনেকগুলো গণ বা জাতি নিয়ে গঠিত একটি পরিবারের অংশ। আশ্চর্যজনকভাবে, এই নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটিকে অদ্ভুত কারণে মানুষ বারবার গোপন করতে চেয়েছে। হোমো সেপিয়েন্স নামের এই প্রাণীটি বরাবরই নিজেদেরকে বাকি প্রাণিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখতে চায়, দেখে এসেছে। ভাবখানা এমন, যেন তারা অনাথ একটা প্রজাতি, তারা কোনো পরিবারের অংশ নয়, তাদের কোনো ভাই-বোন নেই, এমনকি পিতা-মাতা বা অন্য কোনো পূর্বপুরুষও নেই। তা কিন্তু একেবারেই সত্য নয়। পছন্দ করুন আর নাই করুন, আমরা গ্রেট এপ (Great Ape) নামের বিশাল জনবহুল এক পরিবারের অংশ। আমাদের পরিবারের জীবিত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাং-ওটাং উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে শিম্পাঞ্জিরা আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে এক নরবানর (Ape) মায়ের দুটি কন্যা সন্তান ছিল। এদের একজন সমস্ত শিম্পাঞ্জির আদিমাতা এবং অন্যজন হল আধুনিক মানুষের প্রাচীনতম নানী।
গল্প বলা কঙ্কাল
হোমো সেপিয়েন্স আরও বিব্রতকর একটা সত্য এতদিন গোপন করে এসেছে। সেপিয়েন্সের যে কেবল অনেকগুলো অসভ্য, বন্য জ্ঞাতিভাই আছে তাই নয়, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে আমাদের বেশ কিছু আপন ভাই বোনও ছিল। আমরা এতদিন নিজেদেরকেই একমাত্র মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি, কারণ গত ১০ হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র এই সেপিয়েন্সরাই পৃথিবীতে মানুষ গোত্রের প্রাণী হিসেবে টিকে আছে। আমরা ইতোমধ্যে যে জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি দেখেছি সেই পদ্ধতি অনুযায়ী ‘মানুষ’ শব্দটার সত্যিকার মানে হল ‘হোমো (Homo) গণের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী’। অতীতে এই ‘হোমো’ নামক গণটির আরও অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। এই বইয়ের শেষের অধ্যায়ে আমরা দেখব, অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো আমাদের এই হোমো গণের অন্য প্রজাতির মানুষদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। এই নামকরণের ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য, আমরা অধিকাংশ সময়ই ‘সেপিয়েন্স’ বলতে শুধু হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটিকে বুঝাবো, আর ‘মানুষ’ শব্দটা হোমো গণের সব প্রজাতির মানুষের জন্য সংরক্ষিত রাখব।
মানুষের প্রথম সন্ধান মেলে পূর্ব আফ্রিকায়, প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। তারা কিন্তু শূন্য থেকে আসে নি, প্রথম দিককার নরবানরের একটি শ্রেণী অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) থেকে বিবর্তনের মাধ্যমেই তাদের উদ্ভব। এ জটিল আকারের নামের সাথে কিন্তু ভূগোলের অস্ট্রেলিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অস্ট্রালোপিথেকাস এর শাব্দিক অর্থ হলো দক্ষিণের নরবানর (Southern ape)। প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে কিছু মানুষ পূর্ব আফ্রিকা ত্যাগ করে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি নতুন জায়গায় এরা বিরূপ অবস্থা, নতুন ধরনের আবহাওয়া ও জলবায়ু, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থা, নতুন নতুন প্রাণী, অচেনা গাছপালা ইত্যাদির সম্মুখীন হয়। এতসব অচেনা অবস্থার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। অনেক অনেক বছর ধরে এরকম চলার পর মানুষের অনেকগুলো আলাদা আলাদা প্রজাতি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করে এবং পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিকেরা নিজেদের মত করে সবগুলো প্রজাতির আলাদা আলাদা ল্যাটিন নামকরণ করেন।

পশ্চিম ইউরেশিয়ায় (ইউরোপ এবং এশিয়া) মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (Homo neanderthalensis) বা সংক্ষেপে নিয়ান্ডার্থাল (Neanderthals)। এর সহজ মানে হল- নিয়ান্ডার উপত্যকার মানুষ। নিয়ান্ডার্থালরা আমাদের থেকে আকারে অনেক বড়সড় এবং পেশীবহুল ছিল। এরা বরফ যুগে পশ্চিম ইউরেশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে নিজেদের খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। এশিয়ার একদম পূর্বের দিকে মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে তাদের নাম হোমো ইরেকটাস (Homo erectus) বা ‘খাড়া মানুষ’। এরা প্রায় ২০ লক্ষ বছর পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে পেরেছে। মানুষের আর কোনো প্রজাতি পৃথিবীতে এত বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি। আজকের আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সও এই ২০ লাখ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পক্ষে আরও এক হাজার বছর পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব হবে কিনা সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়, লাখ লাখ বছর তো অনেক দূরের ব্যাপার!