তার চেয়ে আমরা এইভাবে ভাবতেই পছন্দ করি, ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একটি জঘন্য দানব তৈরি করেছিলেন, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাকে হত্যা করতে হয়েছে। আমরা গল্পটিকে এভাবেই বলতে পছন্দ করি, কারণ গল্পটির এই বয়ান পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়, আমরাই সকল সৃষ্টির সেরা, অতীতে কখনও আমাদের চেয়ে সেরা কিছু ছিল না, ভবিষ্যতেও কিছু থাকবে না। আমাদের নিজেদেরকে উন্নত করার যে কোন চেষ্টা শেষমেষ ব্যর্থ হবে, কারণ চেষ্টায় শরীরের কিছুটা উন্নতি যদি আমরা করতেও পারি, কোনোভাবেই আমরা মানুষের চিন্তা-আবেগ পরিবর্তন করতে পারব না।
বিজ্ঞানীরা যে চেষ্টা করলে কেবল শরীর নয়, মনও নির্মাণ করতে পারেন, ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে মানুষের চেয়েও উন্নত কিছু বানাতে পারেন, আর সেই উন্নত প্রজাতি যে নিয়ান্ডার্থালদের দিকে সেপিয়েন্স যেরকম অবহেলার চোখে তাকাত, সেরকম অবহেলার চোখে আমাদের দিকে তাকাতে পারে, এই সত্যটা হজম করতে আমাদের বেশ কষ্টই হবে।
আজকের দিনের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা এইসব ভবিষ্যতবাণীকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সুযোগ নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে উপরের অনুমানগুলো পুরোপুরি সত্যে রূপান্তরিত হলে আমি বরং একটু অবাকই হব। কারণ, ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অনেক কিছুই শেষমেষ বাস্তবে রূপ নেয় না। সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু অাকস্মিক বাধা এবং আমলে না আনা নতুন কোন পরিস্থিতি। ১৯৪০ এর দিকে যখন দুনিয়াজুড়ে পারমাণবিক গবেষণার তোড়জোড়, তখন ২০০০ সালের পারমাণবিক শক্তিচালিত বিশ্ব সম্পর্কে অনেকেই অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছিলেন। যখন মহাকাশে স্পুটনিক আর অ্যাপোলো ১১ নিক্ষেপ করা হলো, তখন সবাই শতাব্দী শেষ নাগাদ মানুষ মঙ্গল বা প্লুটোয় উপনিবেশ স্থাপন করে বসবাস শুরু করবে এমনটা ভেবেছিলেন। এসব অনুমানের অধিকাংশই বাস্তবে রূপ নেয়নি। অন্যদিকে, সে সময়ে ইন্টারনেটের মত কোনো কিছু সম্পর্কে সেদিনের কেউ অনুমানই করতে পারেনি। অথচ, সেটিই আজকের দিনের বড় বাস্তবতা।
সুতরাং, ভবিষ্যতের কাল্পনিক কোনো যান্ত্রিক সত্ত্বার দায়ের করা আইনি সালিশ থেকে নিরাপদ থাকতে এখনই আপনার বীমা কোম্পানির কাছে দৌড়ানোর দরকার নেই। উপরের কল্পনাগুলো বা দুঃস্বপ্নগুলো কেবল আপনার কল্পনাকে নাড়া দেবার জন্যই। যেটা গুরুত্বের সাথে নেওয়ার বিষয় সেটা হলো, ইতিহাসের পরবর্তী অংশে আমরা যে কেবল প্রযুক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন দেখতে পাব তাই নয়, বরং মানুষের চেতনা এবং পরিচিতির ক্ষেত্রেও সূচিত হবে নানারকম মৌলিক পরিবর্তনের। এসবের মাঝে কিছু পরিবর্তন হয়তো এতটাই বৈপ্লবিক হবে যে তা ‘মানুষ’ নামক প্রাণীটির পরিচয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এসবের আগে আমাদের হাতে আর কতটা সময় অবশিষ্ট আছে? সত্যিকার অর্থে, কেউ এ প্রশ্নের উত্তর জানে না। যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ হয়তো কিছু মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারবে। এ সংক্রান্ত অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ইঙ্গিত করে মৃত্যুকে জয় করতে হয়তো মানুষের পরবর্তী শতাব্দী বা পরবর্তী সহস্রাব্দ লেগে যাবে। কিন্তু, সেটাও যদি সত্যি হয়, মানুষের ৭০,০০০ বছরের ইতিহাসের তুলনায় কয়েক সহস্রাব্দ কীই বা এমন বড় সময়?
যদি ইতিহাসের মঞ্চে প্রজাতি হিসেবে সেপিয়েন্স এর যবনিকার পর্দা নেমেই যায়, এই প্রজাতির অন্তিম প্রজন্মগুলোর সদস্য হিসেবে একটা শেষ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে কিছুটা সময় আমাদের ব্যয় করা উচিত। প্রশ্নটা হলো- আমরা আসলে কী হতে চেয়েছিলাম? এই প্রশ্নটি, যাকে অনেকসময় মানবিক উন্নয়নমূলক প্রশ্ন হিসেবেও অভিহিত করা হয়, হুট করেই আমাদের বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, পণ্ডিত এবং সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ্যমান অগণিত বিতর্ককে কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দেয়। যদি আমাদের উত্তরসূরীরা একটি ভিন্নরকম চেতনার অধিকারী হয় (বা অধিকারী হয় চেতনার চেয়েও উচ্চতর কিছুর যা আমাদের বোধের বাইরে), তাদের কি আদৌ কোন মাথাব্যথা থাকবে খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম বা আজকের দিনের প্রচলিত অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে, সমাজের গঠন সমাজতন্ত্র নাকি পুঁজিবাদ অনুসারে হবে তা কি তাদের কাছে এতটুকু গুরুত্ব বহন করবে, সমাজের ধারণাটাই কি থাকবে আজকের মতো অথবা নারী-পুরুষের লিঙ্গগত বৈষম্য বা সমানাধিকার নিয়ে মাতামাতি করার ইচ্ছে হবে তাদের?
তা সত্ত্বেও ইতিহাসের এই বড় বড় বিতর্কগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানুষের তৈরি এসব দেবতাদের প্রথম প্রজন্ম বিকশিত হবে মানুষেরই গড়ে দেয়া ছাঁচে। পুঁজিবাদ, ইসলাম নাকি নারীবাদ কোন ছাঁচ অনুযায়ী আমরা তাদের গড়ে তুলব? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর ইতিহাস।
বেশিরভাগ মানুষই এসব নিয়ে ভাবতে চান না। এমনকি জৈবনৈতিকতার মত বিষয়গুলোও মূলতঃ আরেকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেটা হলো- ‘আমাদের কী কী করা অনুচিত?’ জীবিত মানুষের উপর কি জিনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত অথবা পরিত্যক্ত ভ্রুণের উপর? স্টেম কোষের উপর? একটি ভেড়ার হুবহু অনুলিপি তৈরি করা কি যুক্তিযুক্ত? অথবা শিম্পাঞ্জির? কিংবা মানুষের? নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এরকম ভাবা সত্যিই বোকামি হবে যে, এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মানুষের নিজেকে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তর করে ফেলার মতো এইসব বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোকে স্থগিত রাখা সম্ভব হবে। এই প্রকল্পগুলো গিলগামেশ প্রকল্পের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বিজ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করুন কেন তারা জিনোম নিয়ে পড়াশোনা করছেন বা একটি মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন বা কম্পিউটারের ভেতর মানব মন বা মানব মস্তিষ্ক তৈরির চেষ্টা করছেন। দশজনের মাঝে নয়জন আপনাকে সেই পরিচিত উত্তর দেবেন- আমরা এসব করছি রোগমুক্তির জন্য, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। যদিও কম্পিউটারের মধ্যে মানব মস্তিষ্ক তৈরি করার প্রভাব মানসিক রোগ সারানোর চেয়ে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী, কিন্তু এটিই তাদের কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের সাধারণ ব্যাখ্যা, কারণ কোনো মানুষই এই ব্যাখ্যার বিরূদ্ধে যেতে পারবে না। এই কারণেই গিলগামেশ প্রকল্প বিজ্ঞানের প্রকল্পগুলোর আলোকবর্তিকা স্বরূপ। এটি বিজ্ঞান যাই করুক, তাকেই ন্যায্য বলে বা সঠিক বলে প্রমাণের দায়িত্ব নেয়। এই সুযোগে ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গিলগামেশের কাঁধে চড়ে নৃত্য করেন। যেহেতু গিলগামেশকে থামানো অসম্ভব, অসম্ভব থামানো ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকেও।