আধুনিক যুগের শেষভাগে এসে ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা সব মানুষের জন্য কিছুটা হলেও সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারার জন্য গর্ববোধ করতে শুরু করেছি। যদিও এই সময়েই তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অসমতা তৈরির সুযোগ। ইতিহাসের পুরোটা সময় জুড়ে অভিজাত শ্রেণীর লোকজন নিজেদেরকে সমাজের নীচু স্তরে বসবাসকারী মানুষদের থেকে শক্তিশালী, চতুর এবং উৎকৃষ্ট বলে দাবি করে এসেছে। তাদের এই দাবি নিছক তাদের ক্ষমতার দম্ভ ছিল, তার কোন জীববৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। কৃষকের ঘরে জন্মানো একজন শিশু এবং রাজপ্রাসাদে জন্ম নেয়া একজন শিশুর সমান বুদ্ধিমান হয়ে জন্ম নেয়ার সুযোগ ছিল। স্বাস্থ্যসেবার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ফলে ধনিক শ্রেণীর এতদিনের এই মিথ্যে অহংকার বস্তুগত সত্যে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এটা কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়। অনেক কল্পবিজ্ঞানের গল্পেই আমরা দেখতে পাই এমন একটি বিশ্বকে যেখানে হুবহু আমাদের মত দেখতে মানুষ থাকে, কিন্তু তাদের থাকে উন্নততর প্রযুক্তি, আলোর বেগে চলা মহাকাশযান আর লেজার বন্দুক। এসব গল্পের মূল নীতিগত এবং রাজনৈতিক সংকটের দিকগুলো কিন্তু আমাদের বর্তমান পৃথিবী থেকেই নেওয়া, লেখক কেবল ভবিষ্যতের কল্পিত পটভূমিতে আবেগ এবং সামাজিক উত্তেজনার মাধ্যমে সেটাকে উপস্থাপন করেন। যদিও ভবিষ্যতের প্রযুক্তির প্রধান উৎকর্ষ কেবল গাড়ি, মহাকাশযান বা যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে নয়, বরং তার আসল উৎকর্ষ খোদ মানবপ্রজাতিকে, তাদের আবেগ এবং ইচ্ছার প্রকৃতিকেই পাল্টে দেবার মাঝে নিহিত। একটা চিরতরুণ সাইবর্গ, যাকে সন্তান উৎপাদন করতে হয় না এবং যাদের পৃথক পৃথক যৌন পরিচয় নেই, যে সরাসরি অন্য সাইবর্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং যার মনোনিবেশ করার এবং তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি এবং যে কখনও রাগ ও দুঃখ বোধ করে না, কিন্তু যার আছে আমাদের কল্পনার অতীত আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা, তার তুলনায় একটা অত্যাধুনিক মহাকাশযানের গুরুত্বও নিতান্ত নগণ্য নয় কি?
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো আমাদের এ ধরনের ভবিষ্যতের গল্প শোনায় না। কারণ, সংজ্ঞানুযায়ীই এ ধরনের ভবিষ্যতের একটি সঠিক বর্ণনাও হবে মানুষের বোধের অতীত। নিয়ান্ডার্থাল দর্শকের জন্য ‘হ্যামলেট’ সিনেমা বানানো হলে যেমন তা হৃদয়ঙ্গম করা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব, তেমনি ভবিষ্যতের মহা-সাইবর্গদের নিয়ে একটি ছবি বানানো হলে তা বোঝাও আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হবে। তার উপর, আমাদের সাথে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের যে পার্থক্য, বর্তমানের মানুষের সাথে ভবিষ্যতের মানুষের পার্থক্য হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। অন্ততঃ নিয়ান্ডার্থাল এবং আমরা দুজনেই মানুষ, কিন্তু আমাদের উত্তরপুরুষরা হয়ে উঠবেন ঈশ্বরপ্রতিম। সুতরাং, বর্তমানের মানুষের পক্ষে তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করাটাই হবে একরকম ধৃষ্টতা।
পদার্থবিজ্ঞানীরা সৃষ্টির শুরুর সময়কার মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের নাম দিয়েছেন ‘সিংগুলারিটি’ (singularity)। এটা এমন একটা সময়, যখন আমাদের চেনা প্রাকৃতিক নিয়ম কানুনের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সময়েরই কোন অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং মহাবিস্ফোরণের আগে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল কিনা, সে প্রশ্নই ছিল অর্থহীন। হয়তো আমরা খুব শিগগির একটি নতুন ‘সিংগুলারিটি’র দিকে ধাবিত হচ্ছি, যেখানে আমি, তুমি, পুরুষ, নারী, ভালবাসা এবং ঘৃণার মত যেসব ধারণাগুলো আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে, সেসবের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এর পরে যা কিছু ঘটবে আমাদের বর্তমানের মানুষদের জন্য তা হবে পুরোপুরি অর্থহীন।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী
১৮১৮ সালে মেরি শেলি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গল্পে একজন বিজ্ঞানী একটি কৃত্রিম সত্ত্বা তৈরি করে যাকে তার স্রষ্টা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন এবং ফলশ্রুতিতে নেমে আসে বিপর্যয়। গত দুই শতকে, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে আমরা এই একই গল্পের অগণিত রূপের মঞ্চায়ন দেখতে পাই। এই গল্পটি বৈজ্ঞানিক কিংবদন্তীর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পটি আমরা যদি ঈশ্বর সাজার চেষ্টা করি এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী জীবন উৎপাদনের চেষ্টা করি, তবে তার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই গল্পটির অর্থ আরও গভীর ও ব্যাপক।
শেষের দিনগুলো দ্রুত ঘনিয়ে আসছে- ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পটি মানুষকে এই সত্যটি সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। যদি কোন আকস্মিক নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাগড়া না দেয়, প্রযুক্তিগত উন্নতির এই লাগামহীন গতি গল্পের মত অচিরেই হোমো সেপিয়েন্সকে নতুন কোনো প্রজাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে ফেলবে। তারা যে কেবল দেখতে আমাদের থেকে আলাদা হবে তাই নয়, তাদের বু্দ্ধিবৃত্তি এবং অনুভূতিও হবে আমাদের থেকে একেবারেই আলাদা। এই ধারণাটিকে বেশিরভাগ মানুষ অস্বস্তির চোখে দেখেন। আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসি, ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে আরাম আয়েশে ভরপুর, আমরা চাইলেই মহাকাশযানে চড়ে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে বেড়িয়ে আসতে পারব। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আমাদের মত আবেগ এবং পরিচয় সম্বলিত মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না, আমাদের স্থান দখল করবে নতুন কোন অচেনা জীব যার কাছে আমাদের আজকের দক্ষতা হবে নিতান্তই তুচ্ছ – এরকম একটি ধারণা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়।