এরও অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে, এই মহাবিশ্বের পৃথিবী নামক একটি গ্রহে নির্দিষ্ট কিছু অণু মিলিত হয়ে বড় আকারের ও আরো জটিল ধরনের বিশেষ কিছু কাঠামো গঠন করে। এদেরকে আমরা এক কথায় বলি ‘জীব’। সমস্ত জীবজগৎ ও তাদের কার্যপ্রণালী নিয়ে আলোচনা করে যে শাস্ত্র তার নাম জীববিজ্ঞান।
প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, সমস্ত জীবজগতের মাঝে হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) নামের একটি বিশেষ প্রজাতি সম্মিলিতভাবে সংস্কৃতি (Culture) নামে একটি ধারণার সূত্রপাত ঘটায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কোনো একটি প্রজাতির ব্যবহৃত সকল বাস্তব উপকরণ, খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, উৎপাদন পদ্ধতি এবং আচার-আচরণকে একসাথে বলা হয় তার সংস্কৃতি। আর হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের সংস্কৃতির ক্রমাগত পরিবর্তনের গল্পকেই বলা হয় ইতিহাস।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ইতিহাসকে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছে। প্রথমটি হল বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব (Cognitive revolution), যা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে। এরপর বিকাশ ঘটে কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের (Agricultural Revolution), যা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসকে দেয় নতুন গতি। সবশেষে, মাত্র ৫০০ বছর আগে সূচনা হয় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (Scientific Revolution)। এই বিপ্লব রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে ইতিহাসের গতিপথ। হয়তো একদিন বিজ্ঞানের এই বিপ্লব মানুষের ইতিহাসের ইতি টেনে সূচনা করবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো যুগের। এই বইয়ে আমরা এই তিন বিপ্লবের প্রভাবে মানুষ এবং জীবজগতের অন্যান্য সদস্যদের পাল্টে যাবার গল্পটাই জানার চেষ্টা করব।
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ ইতিহাসের সূচনার বহু আগে থেকেই পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ ছিল। আধুনিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। এর আগে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে মানুষের পূর্বপুরুষেরা অন্য দশটা সাধারণ প্রাণীর মতোই জীবন যাপন করে এসেছে। তাদের ছিল না হাতির মত বিশাল আকার-আকৃতি, আলাদা করে চেনার মতো প্রখর বুদ্ধিমত্তা কিংবা খাদ্যশৃঙ্খলে একক কোনো আধিপত্য।
২০ লক্ষ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার কোনো গ্রামে হাঁটতে বেরোলে মানুষের চরিত্রের চিরচেনা রূপটাই হয়তো আপনার চোখে পড়ত। আপনি দেখতেন ছোট বাচ্চাদের বুকে আগলে রাখা উদ্বিগ্ন মাকে আর কাছেপিঠেই খেলাধুলায় মেতে থাকা ছোট ছেলেমেয়েদের। দেখতে পেতেন সমাজের নিয়ম ভাঙা সাহসী তরুণদের কিংবা এমন সব বুড়োদের যারা বাকি জীবনটা কোনোরকমে শান্তিতে কাটাতে পারলেই খুশি। হয়তো দেখতেন শারীরিক শক্তি বা বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দরী নারীর মন ভোলাতে ব্যস্ত কিছু যুবককে আর জীবনভর এই সবকিছু দেখে আসা কোনো সবজান্তা, অশীতিপর বৃদ্ধাকেও। এই প্রাচীন মানুষেরা ভালোবেসেছে, খেলাধুলা করেছে, গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একই কাজ করেছে শিম্পাঞ্জি, বেবুন এবং হাতিও। মানুষ তখন কোনোভাবেই প্রাণীকুলের অন্যদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এ রকম কোন লক্ষণই তখন তাদের মধ্যে দেখা যায়নি যেটা দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে যে তাদেরই সুদূর বংশধরেরা একদিন চাঁদের বুকে হাঁটবে, পরমাণুকে দ্বিখণ্ডিত করবে, ডিএনএর রহস্য উন্মোচন করবে অথবা ইতিহাসের বই লিখবে। সুতরাং, প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্পর্কে জানার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হলো, তখন মানুষ খুবই গুরুত্বহীন একটা প্রাণী ছিল। বনমানুষ, মাছি বা পেঙ্গুইনের থেকে পৃথিবীর উপর বেশি প্রভাব মানুষের ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস তাই প্রাণিবিদ্যা বইয়ের সাধারণ একটি অধ্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়।
জীববিজ্ঞানীরা জীবজগতকে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত করেছেন। দুটি প্রাণী মিলনের মাধ্যমে যদি সফলভাবে বংশধর তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে তাদেরকে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। দুটো উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি আরেকটু সহজ ভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আমরা জানি, বিবর্তনের পরম্পরায় একই পূর্বপুরুষ থেকে গাধা এবং ঘোড়ার উৎপত্তি হয়েছে এবং সে কারণেই তাদের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের মাঝে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু, তারা একে অপরের প্রতি খুব কমই যৌন আকর্ষণ বোধ করে। মানুষ চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের মিলনের ফলে উৎপাদিত সন্তান হয় বন্ধ্যা, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এদেরকে আমরা ‘খচ্চর’ নামে চিনি। উৎপাদিত সন্তান বন্ধ্যা হবার কারণ হল, গাধার রূপান্তরিত ডিএনএ কখনই ঘোড়ার ডিএনএর সাথে ভালোভাবে খাপ খায় না, ঘোড়ার ডিএনএ র ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একারণে গাধা ও ঘোড়া একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হলেও তারা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি, বিবর্তনের সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে তাদের দুজনের যাত্রা। অন্যদিকে বুলডগ এবং স্প্যানিয়েল দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা বলে তাদেরকে ভিন্ন প্রজাতির মনে হলেও আসলে তারা কিন্তু একই প্রজাতির সদস্য। কারণ, তারা দুজনেই একই রকম ডিএনএ বহন করছে। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই যৌনক্রিয়ায় আবদ্ধ হতে পারবে, তাদের খুব সুন্দর বাচ্চা হবে এবং সেই বাচ্চারাও পরিণত বয়সে অনেক বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে।