হয়তো আমরা খুব শিগগিরই এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব। ২০০৫ সালে “হিউম্যান ব্রেইন প্রজেক্ট” নামে একটি প্রকল্পের সূচনা হয়। এই প্রকল্প কম্পিউটারের ভেতর একটি পূর্ণাঙ্গ মানব মস্তিষ্ক তৈরি করার আশাবাদ নিয়ে শুরু হয়েছে। যেখানে কম্পিউটারের ভিতরকার ইলেকট্রিক সার্কিটগুলো মানব মস্তিষ্কের নিউরনের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। এই প্রকল্পের পরিচালক দাবি করেছেন, যদি যথাযথ অর্থায়ন পাওয়া যায় তবে এক থেকে দুই দশকের মধ্যে কম্পিউটারের ভেতরে মানব মস্তিষ্কের সমকক্ষ একটি মস্তিষ্ক তৈরি করা সম্ভব যেটি একটি মানুষের মতই কথা বলতে এবং আচরণ করতে পারবে। এই প্রকল্প সফল হলে, চারশ কোটি বছর পর জীবন জৈব যৌগসমূহের সীমাবদ্ধ জগৎ ছাড়িয়ে অজৈব যৌগের অসীম জগতে প্রবেশ করবে। জীবন এমন সব আকার ও আকৃতিতে আবির্ভূত হবে যার কল্পনা করাও বর্তমানের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, বর্তমানের ডিজিটাল কম্পিউটার এবং মানুষের মস্তিষ্ক ও চিন্তা ভিন্নরকম ভাবে কাজ করে। সেটা সত্যি হলে বর্তমান প্রযুক্তির কম্পিউটার দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানব মস্তিষ্ক গড়ে তোলা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে সে চেষ্টা শেষ হবার আগে পর্যন্ত এ সংক্রান্ত ঢালাও মন্তব্য করাটা বোকামির সামিল হতে পারে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, ২০১৩ সালে এই প্রকল্পটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে ১০০ কোটি ইউরো অনুদান লাভ করেছে।১৯
সিংগুলারিটি
বর্তমানে, ভবিষ্যতের অসংখ্য সম্ভাবনার একটি ক্ষুদ্র অংশ সম্পর্কেই কেবল আমরা ধারণা করতে পারছি। কিন্তু তাতেই, এই ২০১৪ সালে এসে, মানুষের সংস্কৃতিকে জীববিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে হচ্ছে। মানুষ কেবল চারপাশের পৃথিবী নয়, বাহিরের পৃথিবী ছাড়িয়ে নিজেদের শরীর ও মনের ভিতর ও বাহির পালটে দেয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। ফলশ্রুতিতে জ্ঞানের অনেক শাখা আর প্রচলিত নিয়ম কানুনই এখন নতুন নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। আইনজীবীদের নতুন করে পরিচয় এবং গোপনীয়তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, সরকারকে গোড়া থেকে ভাবতে হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা আর সম অধিকার নিয়ে, খেলার নিরপেক্ষতা এবং অর্জনকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হচ্ছে ক্রীড়া সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, অবসর ভাতা এবং শ্রমবাজারের আগে যে বয়স ছিল ষাট, এখন তাকে ত্রিশের সমান হিসেবে ভাবতে হচ্ছে। তাদের সবাইকে নীতি নির্ধারণের সময় জৈব প্রকৌশল, সাইবর্গ এবং অজৈব জীবনের মত ব্যাপারগুলোকে মাথায় রাখতে হচ্ছে।
মানুষের প্রথম জিনোম নকশা তৈরি করতে সময় লেগেছিল পনের বছর, আর খরচ হয়েছিল ৩০০ কোটি ডলার। আজকে মাত্র কয়েকশ ডলার খরচ করে মাত্র কয়েক সপ্তাহে আপনি আপনার জিনের নকশা জেনে নিতে পারেন। শুরু হয়েছে ব্যক্তিগত ওষুধপত্রের যুগ- এমন ওষুধ যা কেবল আপনার ডিএনএর সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অচিরেই আপনার পারিবারিক চিকিৎসক অনেকটা নিশ্চয়তার সাথেই আপনাকে জানিয়ে দিতে পারবেন ভবিষ্যতে আপনার যকৃৎ ক্যান্সারের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, হৃদরোগ নিয়ে আপনার তেমন না ভাবলেও চলবে, সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি নির্ণয় করতে পারবেন যে ওষুধটি শতকরা ৯২ জনের জন্য কাজ করে, সেটি আপনার জন্য কার্যকর হবে না। অপরদিকে, যে ওষুধটি অন্যদের জন্য বিষতুল্য, সেটাও আপনার জন্য যর্থার্থ রূপে কাজ করবে। নিখুঁত ওষুধপত্রের দিন আমাদের সামনেই কড়া নাড়ছে।
কিন্তু, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এতসব উন্নতি অনেক নৈতিক প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। ন্যায়শাস্ত্রবিদ এবং আইনবিদদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে ডিএনএ’র সাথে জড়িত ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি নিয়ে। মানুষের ডিএনএ নকশা জানা সহজলভ্য হওয়ায় জীবনবীমা কোম্পানিগুলো কি সবার কাছে থেকে তাদের ডিএনএর নকশা দাবি করবেন? যার জিনে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের সম্ভাবনা বেশি পাওয়া যাবে তার থেকে বেশি পরিমাণ বীমার অর্থ দাবি করবে? চাকরিপ্রার্থীদেরকে কি চাকরির আবেদনপত্রের বদলে ডিএনএর নকশা ফ্যাক্স করে পাঠাতে হবে? একজন চাকরিদাতা কি জিনের নকশা দেখে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করবেন? কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগের ক্ষেত্রে জিনগত বৈষম্যের জন্য কি অভিযুক্ত করা যাবে? যে প্রতিষ্ঠানটি নতুন জীব বা নতুন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবিষ্কার করবে, সে কি তার ডিএনএ নকশার পেটেন্ট করতে পারবে? এটা স্পষ্ট যে, একজন মানুষ একটি মুরগির মালিক হতেই পারে, কিন্তু একজন মানুষের হাতে একটি পুরো প্রজাতির মালিকানা তুলে দেয়া উচিত হবে কি?
এই ধরনের অনিশ্চয়তাগুলো গিলগামেশ প্রকল্পের (Gilgamesh Project) নৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব এবং আমাদের অতিমানব তৈরি করার নতুন সক্ষমতার সম্ভাবনার কাছে স্তিমিত হয়ে আছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা, সারা বিশ্ব জুড়ে বিদ্যমান সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্প, জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প এবং বিশ্বব্যাপী জাতিগুলোর সংবিধান স্বীকার করে নেয় যে, যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া এবং জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা একটি মানবীয় সমাজের আবশ্যক বৈশিষ্ট্য। যতক্ষণ পর্যন্ত ওষুধগুলো কেবল রোগ প্রতিরোধ এবং অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার কাজে ব্যবহৃত হত, ততদিন পর্যন্ত এ ব্যবস্থা নিয়ে কারও মনে কোনো সংশয় ছিল না। যখন ওষুধগুলো মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে তখন কেমন হবে একটি দেশের স্বাস্থ্য প্রকল্প? সব মানুষকে কি সমান সুবিধা নিয়ে সমানভাবে তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হবে, নাকি কেবল ক্ষমতাবানরা এসবের সুবিধা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করে এক একজন অতিমানব হয়ে উঠবে?