পিউজো হলো একটি বিশেষ ঘরানার আইনসিদ্ধ গল্পের নাম যাকে আমরা বলি- ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি (Limited Liability Company)’। এই ধরনের কোম্পানির উদ্ভব মানুষের অনন্য উদ্ভাবনী শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। লক্ষ লক্ষ বছর মানুষ এইসব কোম্পানি ছাড়াই কাটিয়েছে। ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে কেবল মানুষ নামের এই বড় মগজওয়ালা রক্তমাংসের দোপেয়ে প্রাণীটিকেই সম্পদের মালিক হতে দেখা গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ত্রয়োদশ শতকের ফ্রান্সে জিন নামের কেউ যদি একটা মালগাড়ি তৈরির কারখানা দিত, তাহলে জিন নিজেই সেখানে হতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জিনের বানানো একটি গাড়ি কেনার এক সপ্তাহ পর সেটাতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ক্রেতা সরাসরি জিনকে দোষারোপ করতে পারত। ধরা যাক, কারখানা স্থাপনের জন্য জিনকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার করতে হলো এবং শেষমেশ ব্যবসা দাঁড়ালো না। সেক্ষেত্রে জিনকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তার বাড়ি-ঘর, গবাদিপশু বেচে সেই ধার শোধ করতে হতো। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাকে বাধ্য হয়ে সন্তানদেরও দাস হিসেবে বিক্রি করতে হতে পারত। যদি এরপরেও ধার শোধ না হয়তো, তাহলে রাষ্ট্র তাকে নিক্ষেপ করত কারাগারে কিংবা সে হয়ে যেত ঋণদাতার দাস। তার কারখানার যে কোনো ঘটনা এবং পরিস্থিতির জন্য সে এককভাবে দায়ী থাকতো।
আপনি যদি সে সময়ের মানুষ হতেন, তাহলে আপনি নিজের একটা প্রতিষ্ঠান দেবার আগে আপনাকে বারবার এই ঝুঁকিগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হতো। তখনকার দিনে আইন এবং রাষ্ট্রও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করত। মানুষ নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা বা অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিতে ভয় পেত। নিজের ও পরিবারের একেবারে নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এরকম উদ্যোগ নেওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেত না তারা।
এইসব কারণেই মানুষ সমষ্টিগতভাবে সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এই ধরনের কোম্পানির মালিক, বিনিয়োগকারী অথবা ম্যানেজাররা আইনানুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির ভালো মন্দের জন্য দায়ী থাকে না- সব দায় কোম্পানির উপর বর্তায়। কয়েক শতাব্দী হলো এই ধরনের কোম্পানিগুলোই অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে এবং আমরা এসব কোম্পানির ব্যাপারে এখন এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আমরা ভুলেই গিয়েছি, এই কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের কল্পনায়। যুক্তরাষ্ট্রে ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’র একটা কেতাবি নাম আছে – সেটা হলো ‘করপোরেশন’ (Corporation)। নামটির উৎস অনুসন্ধান করা হলে নামটিকে একরকম প্রহসন বলেই মনে হয়। ইংরেজি ‘Corporation’ নামটি এসেছে ল্যাটিন ‘Corpus’ শব্দ থেকে। ‘Corpus’ এর অর্থ হলো যে কোনো কাঠামোর প্রধান অংশ বা শরীর। অথচ সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানিগুলোতে এই প্রধান কাঠামো বলে আসলে কিছুই নেই। যেহেতু কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ কোম্পানির কাঠামো গঠন করে না, আমেরিকার আইন কোম্পানিকেই এমনভাবে বিবেচনা করে যেন কোম্পানিটি একটি রক্ত-মাংসের মানুষ এবং কোম্পানির সব দায়-দায়িত্ব এই কল্পিত সত্ত্বার উপর বর্তায়।
পিউজো কোম্পানির ইতিহাস দেখলে পুরো ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। ১৮৯৬ সাল। আরমান্ড পিউজো (Armand Peugeot) পৈতৃকসূত্রে একটি ধাতব যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার মালিক। সে কারখানায় তখন স্প্রিং, করাত, বাইসাইকেল এসব তৈরি হতো। এরপর তিনি গাড়ি তৈরির ব্যবসায় নামার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। এই লক্ষ্যে তিনি একটি ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’ তৈরি করলেন। নিজের নামে তিনি কোম্পানির নামকরণ করলেন কিন্তু যেহেতু এটা ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’, তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর ভালো-মন্দের জন্য দায়ী থাকলেন না। সুতরাং, যদি এই কোম্পানির বানানো কোন গাড়ি ভেঙে যায় বা এতে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে ক্রেতা পিউজো কোম্পানিকে অভিযুক্ত করতে পারবেন, ব্যক্তি আরমান্ড পিউজোকে নয়। যদি কোম্পানি লক্ষ লক্ষ ফ্রাঙ্ক ধার করে এবং ব্যবসায় মার খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, তবু ‘আরমান্ড পিউজো’ ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগকারীদের এক ফ্রাঙ্কও শোধ করার দায় বহন করেন না। কারণ, ধারটা নিয়েছিলো পিউজো কোম্পানি, ব্যক্তি আরমান্ড পিউজো নন। মানুষ আরমান্ড পিউজো ১৯১৫ সালে মারা যান। কোম্পানি পিউজো এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে-বর্তে আছে।
কৌতূহল জাগতেই পারে, ঠিক কীভাবে মানুষ আরমান্ড পিউজো, ‘পিউজো’ কোম্পানি তৈরি করলেন? আসলে এই ধরনের ঘটনা কিন্তু অনেককাল আগে থেকেই চলে আসছে। এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেই সাধু-সন্ত এবং যাদুকরেরা যুগ যুগ ধরে দেব-দেবী এবং শয়তান তৈরি করে আসছেন, একই পদ্ধতিতে হাজার হাজার ফরাসি যাজক প্রতি রবিবারে চার্চে কল্পনায় যিশু খ্রিস্টের শরীর তৈরি করেন। এই সবগুলো জিনিসেরই উৎপত্তি হয়েছে একটা গল্প বলা এবং মানুষের কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে। ফরাসি যাজকদের ক্ষেত্রে গল্পটা ছিলো ক্যাথলিক চার্চের মারফতে বলা যিশু খ্রিস্টের জীবন ও মৃত্যুর করুণ কাহিনী। এই গল্প অনুযায়ী, যদি একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক আচার-নিষ্ঠা সহকারে পবিত্র পোশাক পরিধান করে তিথি অনুযায়ী সঠিক স্তোত্র পাঠ করেন, তাহলে সাধারণ রুটি এবং মদ হঠাৎ করে ঈশ্বরের মাংস আর রক্তে রূপান্তরিত হয়। ধর্মযাজক পাঠ করতে থাকেন – ‘Hoc est corpus meum!’ (ল্যাটিন ভাষায় ‘এই হলো আমার শরীর’) – ব্যস, রুটি যিশু খ্রিস্টের মাংসে পরিণত হলো! সবাই দেখে তাদের গুরু কত নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সাথে স্তোত্রগুলো পাঠ এবং নিয়ম কানুনগুলো পালন করে। এইসব দেখে লক্ষ লক্ষ ফরাসি ক্যাথলিক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ঈশ্বর সত্যি সত্যিই ওই উৎসর্গ করা রুটি এবং মদের মাঝে আছেন।